রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসককে দেখিয়ে বাইরে বের হয়ে আসছেন মো. জয়নাল (৪৭)। তার হাতে চিকিৎসকের দেওয়া প্রেসক্রিপশন। প্রেসক্রিপশন দেখেই দৌড়ে এলেন কয়েকজন লোক। কিছু না বলেই রোগীর প্রেসক্রিপশনে হাত দিলেন তাদের একজন। অনুমতি না নিয়ে হাত দেওয়ায় রেগে গেলেন মো. জয়নাল। এবার তারা নিজেদের ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি (রিপ্রেজেন্টেটিভ) বলে পরিচয় দিলেন। অনেকে প্রতিবাদ করলেন। তারা সরে গেলেন।

শুধু এই হাসপাতালেই নয়, দেশের প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চলে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্য। রোগী ও এই প্রতিনিধিদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি, মারামারিসহ নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা যেন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে রোগীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়টি লঙ্ঘিত হচ্ছে।

‘আপনারা সব জায়গায় গ্যাঞ্জাম করেন। ডাক্তারের কাছে যামু, তাও দ্যাখতে দ্যান না। সেখানেও গ্যাঞ্জাম করেন। আপনারা গিয়া ডাক্তারের তাল অন্যদিকে নিয়ে যান। মানুষের অসুস্থতা নিয়ে আপনাদের চিন্তা নেই। আপনারা আপনাদের কাজে ব্যস্ত।’

এভাবে অভিব্যক্তি জানালেন আর হাঁটছিলেন মো. মুনসুর হোসেন নামের এক রোগী। তিনি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসক দেখিয়ে বের হওয়ার পরই ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের উৎপাতে খুবই বিরক্ত হন। কারণ চিকিৎসকের রুমের বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গে ওষুধ কোম্পানির কয়েকজন ঘিরে ধরে তার প্রেসক্রিপশন নিয়ে নেন এবং ছবি তোলেন। তাকে বেশকিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তার পরও প্রতিনিধিদের ছবি তোলা শেষ হয় না। তখন তিনি প্রেসক্রিপশন টেনে নিয়ে হাঁটা শুরু করেন।

কিন্তু যে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি ছবি তুলতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, তিনি রোগীর পিছু নিলেন। রোগীর সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিলেন আর অনুরোধ করছিলেন, যাতে তাকে ছবি তুলতে দেওয়া হয়। খুব নাছোড়বান্দা তিনি। ছবি তুলবেনই। আর রোগীরও মন গলছে না। রোগী হাঁটতে ছিলেন আর বলছিলেন ওষুধ কোম্পানি প্রতিনিধিদের প্রতি ক্ষোভের কথা। হাঁটতে হাঁটতে বারান্দার দক্ষিণ পাশে যেখান থেকে রোগী বাইরে বের হবেন, সেখানে গিয়ে তার মন নরম হলো। তিনি ছবি তুলতে দিলেন।

তিনি যখন ছবি তুলছিলেন, তখন ওই রোগী বলছিলেন, ‘আমরা ডাক্তার দেখাইতে যাই, সেখানে গিয়েও শান্তিমতো ডাক্তার দেখাতে পারি না। ডাক্তার যখন খেয়াল করেন একটা রোগীর দিকে, তখন আপনি গিয়ে একটা অন্য কথা বললেন, তখন ডাক্তারের খেয়ালটা কই যায়?

ওষুধ কোম্পানির ওই প্রতিনিধি ছবি তুলে চলে গেলে কথা হয় ওই রোগী মো. মুনসুর হোসেনের সঙ্গে। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানির লোক রোগী দেখার সময় ভেতরে কেন ঢুকবে? আমি দেখছি ডাক্তার অনেক সময় তাদের বের করে দেন। রোগী দেখার সময় তারা ঢুকলে বিরক্ত হন, কিন্তু বের করে দিলে পরে আবার আরেকজন এসে ঢোকেন। এদের জ¦ালায় ডাক্তারের কাছে এসেও শান্তি নেই। এই দেখেন আমি ব্যস্ত। নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছি। ফিরে যাব। ব্যস্ততা আছে। তারা তিন-চারজন মিলে ঘিরে ধরতেছে। আর ছবি তুলতেছে।’

হার্টের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসা মো. মুনসুর হোসেন নামের এই রোগী বলেন, ‘আমি ওনাদের ওপর এই জন্য রাগ হয়েছি। কারণ যখন একজন ডাক্তার রোগীর দিকে খেয়াল করেন' ওষুধ কোম্পানির লোক গিয়ে যখন তাদের প্রাইজ দিতে যায়; তখন সেই ডাক্তারের খেয়ালটা কোন দিকে যায়? রোগীর প্রতি তখন সেভাবে মনোযোগ থাকে না। বুঝতে পারছেন বিষয়টা। আমি যদিও কম শিক্ষিত থাকি, তবু বিষয়টা কিছুটা বুঝি।’

গত বুধবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে অপেক্ষা করে দেখা যায়, যখনই একজন রোগী চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বের হন' তখনই ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা মুহূর্তের মধ্যে রোগীকে ঘিরে ধরেন। শুরু করেন ব্যবস্থাপত্র নিয়ে টানাটানি। রোগী কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার হাত থেকে ব্যবস্থাপত্র চলে যায় কোম্পানির প্রতিনিধিদের হাতে। রোগী যেন অসহায়। তার ব্যবস্থাপত্র নিয়ে শুরু হয় ছবি তোলার প্রতিযোগিতা। ততক্ষণ রোগী দাঁড়িয়ে থাকেন অসহায়ের মতো। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ চিত্র শুধু একদিনের নয়; প্রতিদিনের।যতক্ষণ বহির্বিভাগে ডাক্তার রোগী দেখেন ততক্ষণই চলে এভাবে ছবি তোলার প্রতিযোগিতা। এই চিত্র শুধু এই হাসপাতালেই নয়' রাজধানীর প্রতিটি হাসপাতালের চিত্র একই।

ছবি তুলে নিয়ে কী করা হয় জানতে চাইলে ওষুধ কোম্পানির এক প্রতিনিধি বলেন, ‘আমরা কোম্পানিকে দিই।’ প্রতিদিন কতজনের ছবি তুলতে হবে এমন কোনো টার্গেট আছেÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, এ রকম কোনো টার্গেট নেই। ছবি তোলার পর আমরা দেখি, আমাদের বসরা দেখেন, আমাদের ডাক্তার কোম্পানির ওষুধ লিখেছেন কিনা।’ এরপর তিনি বলেন, ‘ভাই আমার বস আছে। আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে দেখলে আমার চাকরি চলে যাবে।’ কোন কোম্পানিতে আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুরো বাংলাদেশ ঘোরা লাগে, আজকে এখানে আছি। কালকে চলে যাব ঢাকার বাইরে। আমি তো প্রতিদিন এখানে আসি না।’

একটু পরে তিনি বলেন, ‘আপনারা যদি ভালো করে তথ্য নেন, তা হলে বাইরে যান। বাইরে ইনসেপ্টার বসরা আছেন। ঘুরতেছেন। অরা ভালো করে তথ্য দেবে। ইনসেপ্টা কোম্পানির বস আসছিল। আছে না চলে গেল দেখিনি।’ পরে তিনি দ্রæত ওখান থেকে চলে যান। গিয়ে দাঁড়ান বাইরে বারান্দায়। সেখানে গিয়ে রোগী ধরে ছবি তুলতে থাকেন। এ প্রতিবেদককে দেখলেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে যান। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কমলা রঙের শার্ট পরা এই ব্যক্তি অপসোনিনে চাকরি করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওষুধ কোম্পানির এক প্রতিনিধি বলেন, ‘যখন দেখা যায় কোনো ডাক্তার আমাদের ওষুধ কম লিখছেন বা লিখছেন না, তখন তাকে টার্গেট করে তার সঙ্গে নেটওয়ার্ক ও সম্পর্ক জোরালো করার চেষ্টা করা হয়। ওষুধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের গিফট দেওয়া হয়। যাতে তিনি আমাদের ওষুধ লেখেন।’

রোগীদের এভাবে বিরক্ত করেন, খারাপ লাগে না' এমন প্রশ্নে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি বলেন, খারাপ তো লাগেই। কিন্তু কী করব বলেন, চাকরি করতে হলে তো অফিসের চাওয়াটা পূরণ করতে হয়। না হলে তো চাকরি থাকবে না। সমস্যা তো সব ওপরে। তারা যদি আমাদের এভাবে নির্দেশনা না দেন, তা হলে আমরা তো এটা করব না।’

যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা মো. মিঠু নামের এক রোগী ভোরের আকাশকে বলেন, ‘আমার কি সমস্যা। আমার ব্যক্তিগত তথ্য চলে যাচ্ছে তাদের হাতে। তা ছাড়া অনেক সময় এদের চাপে হোক বা এদের থেকে প্রভাবিত হয়ে হোক' ডাক্তাররাও নামি কোম্পানির ওষুধ বাদ দিয়ে নরমাল কোম্পানির ওষুধ লেখেন। ফলে রোগীও সমস্যায় পড়েন। সব কোম্পানির ওষুধে কিন্তু সব রোগের জন্য ভালো কাজ করে না। এতে কিন্তু ডাক্তারেরও বদনাম হয়। তাদের কোনোভাবেই হাসপাতালে ঢুকতে দেওয়া উচিত নয়।’

গত ১৪ জানুয়ারি নগরীর শেরেবাংলা নগরের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানেও (পঙ্গু হাসপাতাল) ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্য লক্ষ করা গেছে। চিকিৎসকের কক্ষের দরজায় লেখা সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কোনো ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির দেখা করার নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হয় না। রোগীরা বের হলেই ব্যবস্থাপত্র নিয়ে করা হচ্ছে টানাহেঁচড়া।

হার্ট অ্যাটাকের রোগী মো. ফয়সাল (৫১)। ইমার্জেন্সি বিভাগে দেখিয়ে তাকে ভর্তি করাতে ব্যস্ত ছেলে জমির উদ্দিন। তিনি ট্রলিম্যানের পেছনে হাতে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। দৌড়ে গিয়ে ওষুধ কোম্পানির এক প্রতিনিধি প্রেসক্রিপশন দেখানোর আবদার জানালেন। সময় না থাকার কথা জানিয়ে এড়িয়ে গেলেন জমির উদ্দিন। তারপরও হাল ছাড়ে না প্রতিনিধি। কিন্তু জমির উদ্দিনের চোখ রাঙানোতে ফিসফিস করে সরে গেলেন ওই প্রতিনিধি। হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার আবুল কালাম জানান, নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরও প্রতিনিধিদের ভিড় লেগেই থাকে। রোগী ও তাদের অভিভাবকদের প্রায় সময় বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। তাদের সামাল দিতে বাড়তি নিরাপত্তাকর্মীও রাখা হয়েছে বলে জানান আবুল কালাম।

পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবদুল গনি মোল্লা ভোরের আকাশকে বলেন, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের প্রবেশ করার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। প্রয়োজনে দুপুরের পর অনুমতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে বলে জানান অধ্যাপক ডা. আবদুল গনি মোল্লা।

এদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওষুধ কোম্পানি প্রতিনিধিদের কয়েকজন ভোরের আকাশকে বলেন, কোন চিকিৎসক কোন কোম্পানির ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লেখেন, তা জানতে আমরা রোগীদের প্রেসক্রিপশন দেখানোর অনুরোধ করে থাকি। জোর করে প্রেসক্রিপশন দেখার অভিযোগ অস্বীকার করেন তারা। তারা আরো জানান, প্রেসক্রিপশনে তাদের কোম্পানির ওষুধ লেখার জন্য প্রতি মাসেই কলম, পেড, চাবির রিং থেকে শুরু করে টিভি-ফ্রিজসহ মোটা অংকের উপহার দেন তারা ডাক্তারদের। বিনিময়ে প্রেসক্রিপশনে আমাদের ওষুধ লেখার গোপন চুক্তি থাকে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সস ও হাসপাতালে গত ১৫ জানুয়ারি দুপুরে সরেজমিনে দেখা, হাসপাতালের সামনে এবং ভেতরে বিভিন্ন চিকিৎসকের কক্ষের সামনে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের ভিড় লেগেই আছে। নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে তারা ভিজিট করে রোগীদের চিকিৎসাসেবায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছেন। ভবনটির নিচতলায় আবাসিক চিকিৎসক ও আশপাশের কয়েকটি কক্ষের সামনে প্রতিনিধিদের অবাধ বিচরণ যেন একটু বেশি। সম্মতি নিয়ে কয়েকজন রোগীর প্রেসক্রিপশন দেখতেও প্রতিনিধিদের দেখা গেছে।

দরিদ্র ও সহজ-সরল রোগী ও তাদের অভিভাবকদের প্রতিনিধিরা বেশি টার্গেট করে। প্রেসক্রিপশন দেখানোর ক্ষেত্রে এ ধরনের লোকজনের কাছ থেকে প্রতিনিধিরা বেশি বাধার সম্মুখীন হয় না। একটি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি মো. হাশেম ভোরের আকাশকে বলেন, চিকিৎসা সেক্টরে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির আবিষ্কৃত নতুন নতুন ওষুধের বিষয়ে বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকদের অবহিত করার দায়িত্ব পালন করেন প্রতিনিধিরা। তারা ওষুধের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন, যাতে চিকিৎসকরা তা যাচাই করার পর রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেন। এখানে কথা হয় গুলশানের নদ্দা এলাকার সুফিয়া বেগমের সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘মাথাব্যথা নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলাম। ডাক্তারের কাছ থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কয়েকজন লোক আমার প্রেসক্রিপশন নিয়ে মোবাইলে ছবি তোলা শুরু করল। আমি এমনিতেই রোগী মানুষ, তাতে আবার হয়রানি।’ তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন সুফিয়া বেগম।