logo
আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১১:১২
নির্যাতন ও মাদক মামলার নেপথ্যে ৩ লাখ টাকা
রুদ্র মিজান

নির্যাতন ও মাদক মামলার নেপথ্যে ৩ লাখ টাকা

দাবি ছিল তিন লাখ টাকা। টাকা পেতে স্ত্রীর সামনে বেদম পেটানো হয় আসামিকে। ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করে পুলিশের পায়ে ধরে মাফ চাইলে রেহাই মেলেনি। শেষ পর্যন্ত দাবি করা টাকা দিতে না পারায় ‘চোরাই মোবাইল ফোন বিক্রির অভিযোগ’ পাল্টে হয়ে যায় মাদক মামলা। রাজধানীর মিরপুরের পল্লবী থানার পুলিশ ও ফর্মার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেছেন হাবিব নামে এক যুবকের স্ত্রী সাথী আক্তার। এ বিষয়ে পুলিশের ফর্মা হিসেবে পরিচিত মিজানের ভিডিও রেকর্ড রয়েছে এই প্রতিবেদকের হাতে। তারপরও অভিযোগ অস্বীকার করেছে পুলিশ।

ঘটনার শুরু গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে। হঠাৎ করেই পল্লবীর ই-ব্লকের পাঁচ নম্বর লাইনের হাবিবের ৯ নম্বর ভাড়া বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। হাবিবের স্ত্রী সাথী আক্তার জানান, হাবিব তখন বাসায় মোবাইল ফোন মেরামত করছিলেন। কালশী এলাকায় পুরাতন অকেজো ফোন ক্রয় করে তা মেরামত করে বিক্রি করেন হাবিব। ওই সময় পুলিশের ফর্মা মিজানসহ অজ্ঞাত দুজন ফর্মাসহ পল্লবী থানার এসআই কাজী রায়হানুর রহমান ও এএসআই মাহবুবের নেতৃত্বে অভিযান চালায়। এ সময় বাসা থেকে পুরাতন, ভাঙা প্রায় দুই শ মোবাইল ফোন জব্দ করে নিয়ে যায় পুলিশ।

অভিযোগ করা হয়, চোরাই মোবাইল মেরামত করে বিক্রি করেন হাবিব। কিন্তু থানায় নিয়ে যাওয়ার পরই ভিন্ন ঘটনা। হাবিবকে দিয়েই তার স্ত্রী ও স্বজনদের ডেকে নেওয়া হয় থানায়। রাত তখন প্রায় ১২টা। থানা ভবনের চার তলার এক কর্নারে একটি চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয় হাবিবকে। তখন হাবিবের স্ত্রী সাথীর সঙ্গে ছিলেন তার শাশুড়ি, মামা বাহাদুর মিয়া, স্বামী হাবিরের বন্ধু হাসান। হাবিবের কাছে যেতে চাইলে সাথীকে বাধা দেয় পুলিশ। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয় হাবিব ও সাথীকে। বাধ্য হয়ে সাথী একটু দূরে সোফায় গিয়ে অন্যদের সঙ্গে বসেন।

এর মধ্যেই হঠাৎ শুনতে পান মারের শব্দ। হাবিবের গালে থাপ্পড় দিচ্ছিলেন এএসআই মাহবুব। এর মধ্যেই ফ্লোরে শুইতে বলেন। ফ্লোরে না শুইলে চেয়ার থেকে লাথি মেরে নিচে ফেলে দেন এএসআই মাহবুব। এসময় ফর্মা মিজান ও শামীমসহ তিন-চার পুলিশ সদস্য ছিলেন। পাশেই বসা ছিলেন এসআই কাজী রায়হানুর রহমান। ফ্লোরে ফেলে লাঠি দিয়ে পা, উরু, কোমরে পিটাতে থাকেন মাহবুব। মারধরের শিকার হাবিব হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। মাহবুবের পা ধরে ক্ষমা চাচ্ছিলেন।

এ সময় কেন মারতেছেন জানতে চাইলে সাথীকে ধমক দেন মাহবুব। তিনি তখন হাবিবকে গালি দিয়ে বলেন, ওদের ৩ লাখ টাকা দিতে বল। নইলে হেরোইনের মামলা দেব। তিন বছরেও জেল থেকে ছাড়া পাবি না। সাথী তখন হেরোইন মামলা কেন দিবেন জানতে চাইলে ৩ লাখ না দিলে মাদক মামলাই দেওয়া হবে বলে জানান এএসআই মাহবুব।

মিজান তখন সাথীকে বলছিলেন, টাকা নিয়ে আসেন। একইভাবে এসআই রায়হান বলেন, টাকা নিয়ে আসেন। এএসআই মাহবুব বলেন, টাকা দে নইলে জামাইকে আরো পিটাব। নিরুপায় হয়ে সাথী তখন তাদের জানান, তার কাছে এত টাকা নেই। গরিব মানুষ এত টাকা দেওয়ার সাধ্য নেই।

রাত আড়াইটার দিকে থানা থেকে বের হন হাবিবের স্ত্রী ও স্বজনরা। এ সময় তাদের সঙ্গে থানার পশ্চিম দিকে ফ্লাইওভারের নিচে গিয়ে কথা বলেন ফর্মা মিজান। তিনি জানান, টাকা দিতে হবে নইলে মাদক মামলায় আসামি করা হবে। ১০ হাজার টাকা দিতে পারবেন জানালে অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যান মিজান। সাথী অভিযোগ করেন, দাবিকৃত ৩ লাখ টাকা না দিতে পারায় হাবিবের হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করা হয় থানায়। থানা ভবনের সিলিংয়ে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয় তাকে। এ সময় বেশ কয়েকবার বমি করেছেন হাবিব।

এসব বিষয়ে এসআই কাজী রায়হানুর রহমান সব শোনার পর তার সঙ্গে সরাসরি দেখা করতে বলেন এই প্রতিবেদককে। একইভাবে এএসআই মাহবুব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এসআই রায়হানের সঙ্গে কথা বলতে। ৩ লাখ টাকা দাবি ও থানায় নিয়ে মারধরের বিষয়ে প্রশ্ন করলে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন এএসআই মাহবুব।

খুদে ব্যবসায়ী হাবিবকে নির্যাতন ও মিথ্যা মামলার বিষয়ে গত ১২ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) বরাবর পৃথক অভিযোগ দিয়েছেন তার স্ত্রী সাথী আক্তার। সাথী আক্তার জানান, তারা নিন্ম আয়ের মানুষ। হাবিব জেলে থাকায় দুটি সন্তান নিয়ে অসহায়ভাবে দিনাতিপাত করছেন তিনি। তিনি বলেন, টাকার জন্য অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে আমার স্বামীকে। চোখের সামনে স্বামীকে এভাবে নির্যাতন করা কোনো নারী সহ্য করতে পারবে না। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন এই নারী।

ঢাকা মেট্রোপলিটনের মিরপুর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) আ স ম মাহতাব উদ্দিন বলেন, বিষয়টি জানা নেই। তবে অভিযোগ পেলে এটি দেখব।