বাঙালির ঐতিহ্য জামদানি। বিয়ে থেকে শুরু করে সব অনুষ্ঠানেই বাঙালি নারীদের প্রথম পছন্দ এই শাড়ি। শুধু বাঙালি নারী নয়, উপমহাদেশের নারীরা বহুলভাবে ব্যবহার করেন এই শাড়ি; যার গণ্ডি পেরিয়ে যাচ্ছে ইউরোপেও।
জামদানি শাড়ির একটি ডিজাইনের নাম ‘সুরমাদানি’। এ শাড়ি তৈরি করতে দুজন তাঁতির প্রায় দুই মাস সময় লাগে। সেই শাড়িটি তৈরি করছেন শীতলক্ষ্যা নদীতীরঘেঁষা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বিসিক জামদানিপল্লির এক তাঁতি। হাতের কারুকার্যে তৈরিকৃত এই শাড়ি সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে যাবে পাশের দেশ ভারতে। সেখানকার এক নায়িকার শরীরে জড়াবে এই শাড়ি।
‘সুরমাদানি’ নামের এই শাড়ি বুনছেন রূপগঞ্জের কারিগর আলম। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ‘ভারতীয় এক নায়িকার জন্য শাড়ি বুনছি। সুরমাদানি নামের ডিজাইনের শাড়িটি অনেক দামি কাপড়ের।
এর আগেও আমি যে শাড়িটা বানাইছিলাম, সেটা ভারতীয় এক নায়িকা পরছিলেন। পরে অনেকগুলো শাড়ি বানাইছিলাম। ওই অর্ডারটা আমার কোম্পানি আনছিল ভারতীয় এক লোকের কাছ থেকে। আমি মজুরি পাইছিলাম ৩০ হাজার টাকা করে।’
সুরমাদানি ছাড়াও রূপগঞ্জের বিসিক নগরীতে মদনপাইর, করলাপাইর, পাটিতর, ঝুপ্পাপাইর তারাফুল, ঝামবুড়াসহ নানা বাহারি রঙের জামদানি শাড়ি তৈরি করা হয়। বিভিন্ন উৎসবকে ঘিরে নানান রঙের সুতায় হাতে বোনা এসব শাড়ি চড়া মূল্যে বিক্রি হয়ে থাকে। তাই তো দেশীয় এ পণ্য তৈরি করতে বছরের বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকেন রূপগঞ্জের তিন শতাধিক তাঁতি ও কারিগর।
বিসিকের রূপগঞ্জ কার্যালয়ের তথ্যমতে, দেশের বস্ত্রশিল্পের ঐতিহ্যবাহী জামদানি দেশ-বিদেশে সুনাম ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাঁতিদের একত্রিত করে ১৯৯১ সালে রূপগঞ্জের নোয়াপাড়া গ্রামে ২০ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হয় জামদানিপল্লি। এতে ব্যয় হয় প্রায় ৬ কোটি টাকা।
এ শিল্পনগরীতে কারুশিল্পীদের জন্য রয়েছে ৪০৭টি প্লট। রূপগঞ্জের এ তাঁতিপল্লির চাহিদা রয়েছে দেশজুড়েই। তাই তো বছরের বেশিরভাগ সময় নির্ঘুম ব্যস্ত রাত কাটান কারিগরা। আর আসন্ন ঈদুল ফিতর সামনে রেখে রাত-দিন সমানতালে কাজ করছেন কয়েক হাজার কারিগর।
বাবা ও দাদার পেশাকে ধরে রেখেছেন জামদানি কারিগর ইউসুফ মিয়া। শাড়ি তৈরি তার কাছে অনেক আনন্দের ব্যাপার। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ‘আমার হাতে বোনা জামদানি শাড়ি পরতে দেখলে আমার কাছে অনেক ভালো লাগে। ৮ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা দামের শাড়ির কাজ করি আমি।’
শাড়ি তৈরির জন্য সুতাকে বিভিন্ন রঙের করে থাকেন সুলমান। তার সুতা দিয়েই তাঁতিরা বুনে থাকেন শাড়ি। তিনি বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের টানবাজার থেকে সুতা কিনে এনে ওয়াশ করি। এরপর এসব সুতা বিভিন্ন রঙের করি। আমার দোকানে যত ধরনের সুতা আছে, এগুলো আমার হাতে করা। এখানকার তাঁতিরা যার যে কালার লাগে, কিনে নিয়ে যায়। এরপর তারা জামদানি শাড়ি তৈরি করে।’
৩০ বছর ধরে জামদানি তৈরি করে তা সারা দেশে বিক্রি করছেন রমজান তাঁতি। তার কারখানায় ১৫টি তাঁত রয়েছে। সেখানে অন্তত ৩৫ কারিগর ও সহকারী জামদানি বুনে থাকেন। এ কারখানার জামদানি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও বিক্রি হয়।
তিনি বলেন, ‘জামদানি বিশ্বের বাজারে ঐতিহ্যবাহী একটি পণ্য। সারা বিশ্বে জামদানি জিয়াই পণ্য হিসেবে ঘোষিত।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা কারখানায় যেসব জামদানি তৈরি করি, তার দাম ১০ হাজার থেকে শুরু করে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত। এ পল্লির তাঁতি ও কারিগররা সরকারের পক্ষ থেকে তেমন সুযোগ-সুবিধা পান না। যদি পেতেন, তাহলে আরো উন্নতি করতে পারতেন।’
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে তাঁতে জামদানি শাড়ি বুনছেন কারিগররা। ছবি- ভোরের আকাশ
সোহাগ জামদানি ডাইভিং ফ্যাক্টরির মালিক মোহাম্মদ সোহাগ বলেন, ‘দোকান থেকে সুতা সংগ্রহ করার পর সেগুলো তাঁতখানায় এনে কারিগরদের চাহিদামতো দেওয়া হয়। এরপর কারিগররা শাড়ি বুনতে থাকেন। নানারকম নকশা দিয়ে বোনা হয় শাড়িগুলো। একটি জামদানি শাড়ি বানাতে ১৫ থেকে ৯০ দিন পর্যন্ত সময় লাগে।
‘তবে সময় নির্ভর করে ডিজাইন ও দামের ওপর। এরপর সেগুলো হাটবাজার, দোকান ও অনলাইনে বিক্রি হয়। এখান থেকে যারা শাড়ি কিনে নেন, তারা বড় বড় মার্কেটে নিয়ে বেশি দামে বিক্রি করেন। তাছাড়া অনেক বড় বড় পোশাক কোম্পানিও এখানকার শাড়ি কিনে তাদের পণ্য হিসেবে বিক্রি করেন।’
তিনি বলেন, ‘রূপগঞ্জের এ পল্লি দেশের একমাত্র জামদানি তৈরি করার এলাকা। এটা প্রচার হলে আমাদের ব্যবসা আরো বাড়বে। ক্রেতারা সরাসরি আমাদের কাছ থেকে পণ্য নিলে তারা যেমন লাভবান হবেন, তেমনি আমরাও লাভবান হব।’
নকল পণ্যের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাজারে অনেক নকল জামদানি রয়েছে, যেগুলো মেশিনে তৈরি করা হয়। ক্রেতাকে এই এলাকার জামদানি বলে নকল জামদানিও ধরিয়ে দিচ্ছে। তাই ক্রেতাদের কাছে অনুরোধ, আপনারা দেখেবুঝে কিনবেন।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ নুসরাত জাহান বলেন, রূপগঞ্জের জামদানিপল্লিসহ আশপাশের এলাকাগুলো মিলিয়ে এ উপজেলা প্রায় ৩ হাজার তাঁতি কাজ করেন। করোনার মহামারির জন্য তারা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
‘সেই ক্ষতি কাটিয়ে সামনের ঈদকে ঘিরে নানা রঙের জামদানির জন্য কাজ করছেন তারা। সরকারিভাবে প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের সহযোগিতা করতে আমরা চেষ্টা করছি।’
বর্তমানে জামদানি শাড়ি মেশিনে তৈরি হওয়ায় অনেক তাঁতি নিজেদের পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তাদের ফিরিয়ে আনতে ঢাকার মসলিনসহ নানা রকম উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী।