logo
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০৮:২৬
মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
রক্তে রাঙানো একুশ
মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ

রক্তে রাঙানো একুশ

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ছবি- এম খোকন সিকদার

স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে/কে বাঁচিতে চায়? দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে/কে পরিবে পায়- (রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়) যার জীবন আছে সে স্বাধীনতা চায়। সৃষ্টির প্রতিটি জীব-অণুজীব স্বাধীনতাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচে। চাই চলাফেরার স্বাধীনতা, ভাষার স্বাধীনতা, নিজস্ব সাংস্কৃতির স্বাধীনতা।

শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই স্বাধীনতার সুখে বিভোর হতে চান। কারণ সোনার খাঁচায় বন্দি হয়ে আপেল খেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মুক্তাকাশে উড়ে উড়ে না খেয়ে মরা শ্রেয়। এই স্বাধীনতা ছিল না বাংলার মানুষের। পদে পদে স্বাধীনতা হরণ হতে হতে এক সময় নিজ ভাষায় কথা বলার অধিকারটুকু হারাতে বসেন তারা। মুখের ভাষা কাইড়া নেওয়ার পাঁয়তারা করে পাকিস্তানি শাষকেরা।

কিন্তু যে ভাষা সপ্ত পুরুষের, যে ভাষা আমার মায়ের, যে ভাষায় আমরা গল্প শুনি সেই ভাষার দাবি ছাড়তে চাননি বাঙালি। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে প্রাণের ভাষাকে। যা আজ বিশ্বের বিস্ময়।

বাঙালির জীবনে অনন্য চিরঅমিল, চিরভাস্বর, চিরস্মরণীয় একুশে ফেব্রুয়ারি। ইতিহাসের পাতায় পলাশ-শিমুল কৃষ্ণচূড়া হয়ে ফোটা সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউরের রক্তে রাঙানো অমর ২১ শে ফেব্রুয়ারি আজ।

রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ এই দিনটি একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। দিনটি এলেই আমরা ভাষাশহীদের উদ্দেশ্য গেয়ে উঠি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি...। গেয়ে ওঠি মাগো আটই ফাল্গুনের কথা আমরা ভুলি নাই কিংবা বাংলা আমার প্রাণের ভাষা বাংলা আমার প্রাণ/মা ডাকি তাই বাংলাতে আজ বাংলাতে গাই গান।

১৯৫২ সালের এ দিনে ভাষাশহীদদের রক্তে শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল দুঃখিনী বর্ণমালা, মায়ের ভাষা। বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের যে সংগ্রামের সূচনা সেদিন ঘটেছিল, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় পথ বেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই বাঙালির কাছে চির প্রেরণার প্রতীকে পরিণত হয়েছে।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে ঘটেছিল বাঙালির ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার ঘটনা। ‘বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা’ স্লোগানে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেয় বাঙালি তরুণ প্রজন্ম। একুশের চেতনা আমাদের আত্মমর্যাদাশীল করেছে। ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’ চিরকালের এ স্লোগান তাই আজো সমহিমায় ভাস্বর।

শুধু ঢাকাতেই নয়, সারা দেশের স্কুল-কলেজ, জেলা ও থানা প্রশাসনের উদ্যোগে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে দেশের সর্বস্তরের মানুষ। পাড়ায়-মহল্লায় শিশু-কিশোরদের নিজ হাতে গড়া শহীদ মিনারও আজ সেজে উঠবে নতুন প্রজন্মের ফুলেল শ্রদ্ধায়।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তানকে আমরা ইসলামী রাষ্ট্ররূপে গঠন করতে যাচ্ছি।’ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রদেশের ভাষা কী হবে, তা প্রদেশবাসীই স্থির করবেন, কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।

২১ শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়। ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে পুলিশ ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়। এতে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, সফিউররা শাহাদত বরণ করেন। অমর একুশের অনুষ্ঠান আজ আর কেবল বাঙালির নয়, নয় শুধু বাংলাদেশের। দেশের সীমানা পেরিয়ে ভাষা দিবস হয়ে উঠেছে বিশ্বমানের। ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সূত্রপাত বাংলাদেশে হলেও ইউনেস্কোর অনুমোদনে এখন সারা বিশ্বজুড়েই উদযাপিত হয়ে আসছে অমর একুশের অনুষ্ঠান। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সব দেশ, সব জাতি ২১ ফেব্রুয়ারি নিজ নিজ মাতৃভাষার কথা স্মরণ করে। উদযাপন করে ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান।

মহান একুশে ফেব্রুয়ারি এখন বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মাতৃভাষার প্রতীক। দিনটিতে পৃথকভাবে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, মাতৃভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশসহ সব জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় বিশ্ববাসীকে সোচ্চার হতে হবে। তিনি বলেন, মহান ভাষা আন্দোলন বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। ভাষা আন্দোলন ছিল আমাদের মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি নিজস্ব জাতিসত্তা, স্বকীয়তা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষারও আন্দোলন।

প্রতি বছরের মতো এবারো ‘শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উদযাপনে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সরকার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ অবদানের বিষয়টি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিভিন্ন কর্মসূচিতে উপস্থাপন করার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।

কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনগুলোতে সঠিক নিয়মে, সঠিক রং ও মাপে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।

করোনা পরিস্থিতিতে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণপূর্বক দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলো যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আজিমপুর কবরস্থানে ফাতেহা পাঠ ও কোরআনখানির আয়োজনসহ দেশের সব উপাসনালয়ে ভাষাশহীদদের রুহের মাগফেরাতের জন্য প্রার্থনার আয়োজন করা হবে।

যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে প্রতিটি সংগঠনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ৫ জন প্রতিনিধি হিসেবে ও ব্যক্তিপর্যায়ে একসঙ্গে সর্বোচ্চ দুজন শহীদ মিনারে ফুল দিতে পারবেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং দিবসটি পালনে নিয়োজিত সব প্রতিষ্ঠান ও সংলগ্ন এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারকরণে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দিবসটি উপলক্ষে গণযোগাযোগ অধিদপ্তর ঢাকা মহানগরীতে ট্রাকের মাধ্যমে রাজপথে ভ্রাম্যমাণ সংগীতানুষ্ঠান এবং নৌযানের সাহায্যে ঢাকা শহরসংলগ্ন নৌপথে সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজনসহ জেলা-উপজেলায় ভ্রাম্যমাণ চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করবে। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর তিন ধরনের পোস্টার মুদ্রণ করবে, যার মধ্যে প্রথমটি হবে সর্বজনীন, দ্বিতীয়টি স্কুল-কলেজের শিশু-কিশোরদের জন্য এবং তৃতীয়টি বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলো ও বাংলাদেশে অবস্থিত বৈদেশিক দূতাবাসগুলোতে প্রচারের জন্য।

এছাড়া বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তর, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক একাডেমি, বিরিশিরি, নেত্রকোনা, রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি, মনিপুরী ললিতকলা একাডেমি, কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গ্রন্থমেলা, আলোচনা সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন, পামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী, সুন্দর হাতের লেখা ও রচনা প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে।