’৬০-এর দশকে ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার একেবারে সূচনাকাল থেকেই পিয়ারু সরদারের নামের সাথে আমার পরিচয়। আমি ছিলাম বামপন্থি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের একজন কর্মী। ’৬০-এর দশকের শুরুর দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত আইয়ুবী শাসনামলজুড়ে একটানা প্রায় এক দশককাল ধরে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় অফিস ছিল ৩১/১ নং হোসেনী দালান রোডে।
ছাত্র ইউনিয়নের অফিসের জন্য এই এলাকাটি বেছে নেয়া হয়েছিল শুধু এ কারণে নয় যে, তা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি ঢাকার প্রধান উচ্চ বিদ্যাপিঠগুলোর খুব কাছাকাছি। এসব প্রতিষ্ঠান ও তাদের হল-হোস্টেল থেকে হাঁটা পথের দূরত্বের মধ্যে।
এই এলাকাতে ছাত্র ইউনিয়নের অফিস করার আরেকটি বড় কারণ ছিল, এখানে অফিস থাকলে তা পিয়ারু সরদারের প্রটেকশন পাবে। এলাকাটি ছিল পিয়ারু সরদারের প্রভাবাধীন এলাকা। পিয়ারু সরদারের নামটিই বামপন্থি ও আইয়ুববিরোধী গণতান্ত্রিক শক্তির জন্য একটি শক্তিশালী প্রটেকশন- এটিই ছিল একটি সার্বজনীন সরল বিশ্বাস। ধারণা ও বিশ্বাস থেকেই পিয়ারু সরদারের পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
পিয়ারু সরদার ছিলেন ঢাকার ২২ পঞ্চায়েত প্রধানদের মধ্যে অন্যতম একজন। ১৯১১ সালে তার জন্ম। তার পিতা মন্নু সরদারের মৃত্যুর পর স্বাভাবিক রেওয়াজ অনুযায়ী ১৯৪৪ সালে ৩৩ বছর বয়সে নবাব আহসানউল্লাহ তাকে পাগড়ি পরিয়ে সরদার উপাধিতে ভূষিত করেন।
১৭ বছর পঞ্চায়েত সরদারের দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৬১ সালে ৫০ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। কিন্তু প্রয়াত হওয়ার পরেও তাঁর পঞ্চায়েত এলাকায়, যার মধ্যে হোসেনী দালান এলাকাও অন্তর্ভুক্ত ছিল, পিয়ারু সরদারের প্রভাব যে কতটা শক্তভাবে বহাল ছিল তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি নিজেই।
পিয়ারু সরদারের অনুপস্থিতিতে তার ছেলেরা পিতার ঐতিহ্য ও প্রভাবকে অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। হোসেনী দালান এলাকাটি শুধু পিয়ারু সরদারের পঞ্চায়েতভুক্তই ছিল না, এই এলাকাতেই ছিল তার বাড়ি ও অফিস। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় যোগাযোগ কেন্দ্র ও অফিসের জন্য তাই যথার্থভাবেই পিয়ারু সরদারের প্রভাবের আশ্রয়াধীন, তার নিজস্ব মহল্লা হোসেনী দালান এলাকাটিকে বেছে নেয়া হয়েছিল।
পিয়ারু সরদারের প্রভাবাধীন থাকার কারণে এই এলাকায় আইয়ুব-মোনায়েমের পেটোয়া বাহিনীর গুণ্ডারা বা প্রতিক্রিয়াশীলরা কখনোই হামলা করতে বা দাপট দেখাতে পারেনি। বিপদ-আপদে সবসময় আশ্রয় ও সহায়তা পাওয়া গেছে এলাকাবাসীর। পিয়ারু সরদারের মতো নিরাপদ আশ্রয়স্থল বামপন্থি প্রগতিশীলদের জন্য আর কোথায়ই বা পাওয়া যেত? এসব কারণেই দীর্ঘদিন ধরে পিয়ারু সরদারের হোসেনী দালান এলাকাতেই চালু থেকেছে ছাত্র ইউনিয়নের অফিস।
গোপন কমিউনিস্ট পার্টির আন্ডারগ্রাউন্ড নেতাদের মুখে একাধিক প্রসঙ্গে পিয়ারু সরদারের নাম শুনে এ কথা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, ঢাকার এই ‘পিয়ারু সরদার’ ও তার বাড়ির সাথে পার্টির একটি সুসম্পর্ক রয়েছে। পার্টির পলাতক নেতাদের মধ্যে কমরেড মণি সিংহ, কমরেড ফরহাদ, কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী এবং সাহিত্যিক-সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্তের মুখে পিয়ারু সরদারের নাম শুনেছি একাধিকবার।
পিয়ারু সরদারের নামটি প্রথম ‘শহীদ মিনার’ নির্মাণের সাথে যুক্ত রয়েছে।
ছোট-খাটো বৈঠক করতে এমনকি আন্ডারগ্রাউন্ড নেতাদের রাত কাটানোর জন্য আশ্রয়স্থল হিসেবেও বহুবার তার বাসাকে ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি, কমরেড মণি সিংহ নিজেই পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পিয়ারু সরদারের বাসায় পলাতক অবস্থায় একবার রাত কাটিয়েছেন বলে শুনেছি।
পিয়ারু সরদারের নাম উজ্জ্বলাক্ষরে লেখা রয়েছে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের অমর অধ্যায় বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ও তার পরবর্তী ঘটনাবলির সাথে।
পিয়ারু সরদারের বাড়ির অদূরেই ছিল রেললাইন, যার ওপাশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা। তাঁর বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে বেশ টের পাওয়া যেত যে আমতলায় কী হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কী করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজের প্রগতিশীল আন্দোলনের বাতাস ছড়িয়ে পড়ে সবচেয়ে আগে ঢাকার যে মহল্লাটিকে সুবাসিত করেছিল, সেটি হলো পিয়ারু সরদারের হোসেনী দালান ও বকশিবাজার এলাকা। এই এলাকাগুলো একই সাথে হয়ে উঠেছিল আন্দোলনরত ছাত্রদের আশ্রয়স্থল।
পুলিশ হামলা করলে ছাত্র-ছাত্রীরা চট করে রেললাইন পার হয়ে ঢুকে পড়ত হোসেনী দালান মহল্লায়। টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপের ধোঁয়া হোসেনী দালান এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ত। তখন পিয়ারু সরদার ছাত্রদের চোখে পানি দিয়ে জ্বালা কমানোর জন্য নিজের বাসায় বালতি করে পানি জোগাড় করে রাখতেন।
ছাত্রসমাজ ও মহল্লাবাসীর মধ্যে এভাবে গড়ে উঠেছিল একটি ঘনিষ্ঠ সুসম্পর্ক। ছাত্র-জনতার মিলনের অনুঘটক হিসেবে পিয়ারু সরদার পালন করেছিলেন এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা।
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষার অধিকারের জন্য সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা থেকে সরকার ঘোষিত ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল বের করলে একপর্যায়ে মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। ছাত্রদের রক্তে রাজপথ লাল হয়ে ওঠে। শহীদ হন বরকত, সালাম, শফিক, রফিক, জব্বার। আহত ও বন্দি হন শত শত ছাত্রছাত্রী।
গুলিবর্ষণের পরবর্তীতে সরকার ও শাসকদল মুসলিম লীগ প্রচণ্ড দমন-পীড়ন অব্যাহত রাখে। চতুর্দিকে মিথ্যা গুজব ও অপপ্রচারের প্লাবন বইয়ে দেয়। ভাষা আন্দোলন হলে ইসলামের জন্য খাতারনাক, নাস্তিকদের ষড়যন্ত্র, কমিউনিস্টদের চক্রান্ত, ভারত থেকে আসা ‘ধুতি ছেড়ে লুঙ্গি পরা ছদ্মবেশ ধারণকারী’ অনুপ্রবেশকারীদের কাজ ইত্যাদি প্রচারণা সাধারণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হয়।
এই পরিস্থিতির মাঝেই পিয়ারু সরদার তার দেশপ্রেমের পরিচয় দেন। মন শক্ত করে নিজে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে আসেন ভাষা আন্দোলনকে সহায়তা করতে।
২১ ফেব্রুয়ারির একদিন পরেই ছাত্ররা মনস্থির করে যে, ভাষাশহীদদের স্মরণে তারা একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করবে। যে স্থানে গুলি হয়েছে সেখানে নির্মাণ করবে ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ নাম খচিত স্মৃতির মিনার। এই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভই পরে হয়ে ওঠে ‘শহীদ মিনার’।
২৩ ফেব্রুয়ারির রাতেই ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের’ নকশা তৈরি করা হয়। মেডিকেল কলেজ ভবনের সম্প্রসারণের যে কাজ চলছিল তার ঠিকাদার ছিলেন পিয়ারু সরদার। সেখানের জন্য যে বালু ও ইট মজুত ছিল, শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য তা ছিল পর্যাপ্ত। কিন্তু সিমেন্ট রাখা ছিল তালাবদ্ধ গুদামে। গুদামের চাবি খোদ পিয়ারু সরদারের কাছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের দু’জন ছাত্র-কর্মীকে পাঠানো হয় তাঁর কাছে, সিমেন্টের জন্য আবদার নিয়ে। কী বলেন পিয়ারু সরদার- এ দ্বন্দ্ব নিয়ে দুরু দুরু বুকে তারা উপস্থিত হলেন পিয়ারু সরদারের কাছে। সব শুনে পিয়ারু সরদার নিঃশব্দে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। চাবি হাতে ফিরে এসে তা ছাত্রদের হাতে তুলে দিলেন।
শুধু বললেন কাজ শেষ করে পরদিন যেন চাবিটি তাকে ফেরত দিয়ে দেয়া হয়। এভাবে পিয়ারু সরদারের সম্মতিতে ইট, বালু, সিমেন্ট জোগাড় হয়ে যায়। এই সম্মতি দেয়াতে পিয়ারু সরদারের ওপর বড় রকম বিপদও নেমে আসার আশঙ্কা ছিল। তিনি এর পরোয়া করেননি।
ঢাকায় কারফিউ জারি ছিল। সেই কারফিউ-এর মধ্যেই যথাসম্ভব নীরবে শত শত স্বেচ্ছাকর্মীর পরিশ্রমে ২৩ ফেব্রুয়ারি সারারাত জেগে কাজ করে রাতারাতি সেই প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছিল। ৬ ফুট চওড়া ও ১০ ফুট উঁচু সেই স্মৃতিস্তম্ভটি ছিল শক্ত ভিতের ওপর নির্মিত।
২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে উঠে সবাই রাতারাতি নির্মাণ হয়ে যাওয়া ‘স্মৃতিস্তম্ভটি’ দেখে আনন্দে-আবেগে আপ্লুত হয়ে যায়। দলে দলে মানুষ আসতে থাকে সেটিকে দেখতে। বেদিতে ফুল দিয়ে সবাই শ্রদ্ধা জানাতে থাকে বীর শহীদদের প্রতি। মেয়েরা পুষ্পাঞ্জলির সাথে শরীর থেকে গয়না খুলে নিবেদন করে শহীদ মিনারের পাদদেশে। অনেকে টাকা-পয়সা রেখে দেয়।
সেই প্রথম শহীদ মিনারটি ২৬ ফেব্রুয়ারি ভেঙে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর পিয়ারু সরদারের নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এবং উনার তত্ত্বাবধানে সেটি আবার আরো বড় করে নির্মাণ করা হয়েছিল।
’৭১-এ হানাদার বাহিনী কামান দাগিয়ে সেটি আরেকবার ভেঙে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।
আগাগোড়াই জাতির রাজনৈতিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ‘শহীদ মিনার’ পালন করেছে এক অমূল্য উপাদানের ভূমিকা। ‘শহীদ মিনার’কে অবলম্বন করে গড়ে ওঠা সংগ্রামের ধারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়সহ সব প্রগতিশীল সাফল্যগুলো অর্জন করতে সাহস জুগিয়েছে।
পিয়ারু সরদারের সিমেন্ট, ইট, বালু দিয়ে বায়ান্নর প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করতে পারার কারণেই তা সম্ভব হয়েছে। শহীদ মিনার হয়ে উঠেছে গণসংগ্রামের তীর্থস্থান ও শপথবেদি। পিয়ারু সরদারের নামটি প্রথম ‘শহীদ মিনার’ নির্মাণের সাথে যুক্ত রয়েছে। তাই সংগতভাবেই আজ প্রশ্ন করা যায়, পিয়ারু সরদারকে ‘ভাষাসৈনিক’ বলে গণ্য করাটা যথার্থ হবে না কেন? তাকে উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা দেয়া হচ্ছে না কেন?
পিয়ারু সরদার ছিলেন ভাষাসৈনিকদের একজন। গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথে তার হৃদ্যতার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পরও প্রগতিশীলরা পিয়ারু সরদারের পরিবারের আশ্রয় ও সহায়তা পেয়েছে। বিপদে পড়লে সাহায্য পেয়েছে। গোপন বৈঠক করার ক্ষেত্রে সহায়তা পেয়েছে। কোনো কোনো কমিউনিস্ট নেতা তাঁর ও তাঁর ভাইয়ের বাসায় ভাড়া থাকতেন।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ সন্ধ্যার পরে সে রকম একটি বাসাতে পার্টির শীর্ষস্থানীয় আন্ডারগ্রাউন্ড নেতাদের একটি বৈঠক চলছিল। হানাদার বাহিনীর গোলাগুলি ও সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত পার্টির নেতারা সেখানে বসে নির্দেশাবলি প্রদানসহ জরুরি কাজগুলো সম্পাদনে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। আমি নিজে এই ঘটনার কথা জানি।
এই ঘটনা থেকে আঁচ করা যায় যে, পিয়ারু সরদার নামের সেই অসাধারণ সমাজকর্তার সাথে কমিউনিস্টদের সখ্য কত অন্তরঙ্গ ছিল।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি