logo
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৩:৫৮
ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য অনুধাবন, ধারণ ও লালন
ড. আলা উদ্দিন

ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য অনুধাবন, ধারণ ও লালন

প্রতীকী ছবি

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য কেবল মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; পৃথিবীর সকল ভাষায় কথা বলা, তথা মনের ভাব প্রকাশ করার অধিকারের মাঝে নিহিত। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এর তাৎপর্য আরো ব্যাপক।

ভাষা কীভাবে একটি জাতিকে সংগঠিত করে এবং প্রকারান্তরে একটি দেশের স্বাধীনতার ভিত্তি হতে পারে, তা অনুধাবনের জন্য বাঙালির ভাষা আন্দোলনের (১৯৪৮-৫২) অগ্রপশ্চাৎ (১৯৪৮-১৯৭১) বিশ্লেষণ আবশ্যক। ভাষা আন্দোলন মানে কেবল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নয়; ১৯৫২ সালের আগের ও পরের ঘটনাবলি অনুধাবন করতে হবে অন্তঃসম্পর্কিত ঐতিহাসিক বাস্তবতায়।

দেশভাগের পরপরই ভাষা আন্দোলনের বিরূপ বাস্তবতায় পাকিস্তানিদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুভূত হয়েছিল; আর সেখান থেকে পৃথক রাষ্ট্রের ভাবনা জাগ্রত হয়েছে তৎকালীন বাঙালি সমাজে। সেখান থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার উন্মেষ। অর্থাৎ, ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূত্রপাত।

দেশভাগ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে পূর্ব বাংলার প্রতি পাকিস্তানের বিমাতাসুলভ দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তবতায় তৎকালীন বাঙালি ছাত্রসমাজ উপলব্ধি করেছে যে, মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করতে না পারলে দাসত্বের শৃঙ্খল ভাঙ্গা সম্ভব হবে না; মুক্তির সকল সম্ভাবনা ভাষার অধিকারের মাঝে নিহিত। তাই তাঁরা জাতির চূড়ান্ত মুক্তির লক্ষ্যে ভাষার লড়াইয়ে আপ্রাণ ছিলেন।

ভাষা আন্দোলন শুরু হয় দেশভাগের অব্যবহিত পর। নির্দিষ্টভাবে, ১৯৪৮ সালের শুরুর দিক থেকে, যা ১৯৫২ এ গিয়ে চূড়ান্ত রূপ নেয়। তারপর সংশ্লিষ্ট অপরাপর দাবির আন্দোলন করতে ১৯৫৬ এবং এর রেশ ধরে ১৯৬৬ সালের স্বাধিকার আন্দোলন, ও ১৯৭১ এ এসে স্বাধীনতা অর্জন।

অর্থাৎ ভাষা আন্দোলনের প্রভাব, বাঙালি জনসমাজের অনুভূতি, উপলব্ধি, রাজনীতি এবং স্বাধীনতা পর্যন্ত বিস্তৃত। এক কথায় পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের কালক্রমে দুই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ হয়ে হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভিত্তি স্থাপন বা সূত্রপাত ঘটিছেয়ে ভাষা আন্দোলন। তাই এর তাৎপর্য গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে অগ্রপশ্চাৎ আন্তঃসম্পর্কিত ঘটনাবলি ও পরিণতির মধ্য দিয়ে।

১৯৪৭-এর ধর্মভিত্তিক দেশভাগের পরপরই বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানের নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ পেতে শুরু হয়। ধর্মের কথা বলে বিভাজিত হলেও দ্রুত তাদের অর্থ-রাজনৈতিক ও জাতিগত বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচিত হয়। পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলিমদের প্রশ্নে তাদের উদাসীনতা ও বঞ্চনায় তা প্রতিভাত হয়।

পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিমাতাসুলভ আচরণ দেখা দিলেও, তা এত দ্রুত সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষি বাঙালির কথা বলার ওপর নির্দয় আঘাত হানবে, তা অনুনেমেয় ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।

মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতি ছিলেন। অথচ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের (৫৬ শতাংশ) ভাষা বাংলা। যৌক্তিক দাবি সত্ত্বেও শুরু হয় বাংলাকে বাদ দিয়ে কেবল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র।

আন্দোলনের এক পর্যায়ে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় ঘোড়দৌড় মাঠে ঘোষণা করলেন ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’। শেখ মুজিবুর রহমানসহ উপস্থিত ছাত্রসমাজের অনেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদস্বরূপ জানিয়ে দিয়েছিল, ‘মানি না’।

তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন সভায় তিনি আবারো বললেন, ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’। সাথে সাথে উপস্থিত ছাত্ররা চিৎকার করে জানিয়ে দিল ‘না, না, না’। জিন্নাহ প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করেছিলেন।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে উল্লেখ করেছেন, ‘আমার মনে হয় এই প্রথম তাঁর মুখের উপরে তাঁর কথার প্রতিবাদ করল বাংলার ছাত্ররা। এরপর জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন আর কোনোদিন বলেন নাই, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’ (২০১২, ৯৯)।

ইতোমধ্যে পূর্ব বাংলার জনগণ ভাষাসহ নানা বৈষম্য নীতির কারণে মুসলিম লীগের প্রতি আস্থা হারাতে শুরু করে। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের বঞ্চনা ও শোষণের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়ায় ১৯৪৯ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামক একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়, যা পরবর্তীতে অসাম্প্রদায়িক চেতনা উজ্জীবিত হয়ে ‘আওয়ামী লীগ’-এ পরিণত হয়। শুরু হয় নতুন ভাবনার সঞ্চরণ।

এই পরিস্থিতিতে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন নতুন গতি পায়। ছাত্রসমাজ যখন রাষ্ট্রভাষা দিবস উদযাপনের লক্ষ্যে বিক্ষোভ-সমাবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সরকার ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সর্বত্র মিছিল ও সমাবেশ নিষিদ্ধ করে। প্রতিবাদী ছাত্রসমাজ ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারা ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করে ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে (তৎকালীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কাছে অবস্থিত) সভা করে।

ঢাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের হাজার হাজার শিক্ষার্থী সভায় সমবেত হয়। এক পর্যায়ে ছাত্ররা দলে দলে স্লোগান দিতে থাকলে পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ করে। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও পরবর্তীতে গুলি ছোঁড়ে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে রফিক উদ্দিন আহমেদ, আবদুল জব্বার, আবুল বারকাত, আবদুস সালাম গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া আরো অনেকে নিহত ও গুরুতর আহত হন।

অবশেষে রক্তের বিনিময়ে ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালে চরম পরিণতি পেলেও, ভাষার দাবি পূরণ হয়নি। অনেক আলোচনা-আন্দোলনের ফলে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ১৯৫২ সাল থেকে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

বিশ্বে এই প্রথম মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের জন্য কোনো জাতি রক্ত দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এটি বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, যা কেবল বাংলা ভাষার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগকে স্বীকার করছে না, সাথে সাথে পৃথিবীর সকল দেশের সকল জাতির মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারকে সমুন্নত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

বাংলা ভাষা সংস্কৃত বা হিন্দুয়ানি ভাষা; কিংবা ৫৬ শতাংশ মানুশের মাতৃভাষা হওয়া সত্ত্বেও তার স্বীকৃতি না দেওয়া, ইত্যাদি ঘটনায় সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক চরিত্র পরিষ্কারভাবে পরিস্ফুট হয়। ধর্মভিত্তিক দেশ-বিভাগের দৈন্যতায় দ্বিজাতি তত্ত্বের অসারতা থেকে বাঙালির মননে উৎসারিত হয় আসাম্প্রদায়িক ধারা- যা এই বদ্বীপের চিরায়ত ঐতিহ্য। ১

৯৪০-এ যে কৃত্রিমভাবে ধর্মভিত্তিক ধারার জাগরণ ঘটেছিল, তার দৈন্য অনুধাবন করত মওলানা ভাসানী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব প্রমুখ অসাম্প্রদায়িক নেতাদের ভাবাদর্শে ১৯৬০ এর দ্বিতীয় ভাগে অসাম্প্রদায়িক চেতনার জাগরণ ঘটে, যার সফল পরিণতি ১৯৭১-এর স্বাধীনতা।

তাই বলা যায়, ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে কেবল মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারই দেয়নি, একটি লাল-সবুজের পতাকাও উপহার দিয়েছে। আর এঁকে যথাযথভাবে সম্মান প্রদর্শন এখন আমাদের দায়িত্ব। সুতরাং ভাষা আন্দোলন মানে কেবল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নয়; এর শুরু তারও আগে এবং এরপরও তা অব্যাহত রয়েছে; ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে তা আনুধাবন করতে হবে।

মাতৃভাষা বাংলার বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ ভাষার বৈচিত্র্যতার বাহক। কিন্তু প্রমিত বাংলা বানান ও উচ্চারণ নিয়ে রীতিমতো যে মহড়া চলছে তা ভাষা শহীদদের বা ভাষাপ্রেমীদের রীতিমতো আহত করে। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। গরু/গোরু, ঈদ/ইদ, কিংবা কি/কী- এসব বিতর্কের যুক্তিগ্রাহ্য নিষ্পত্তি অপরিহার্য।

আজ থেকে তিন দশক আগেও বিটিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠান (নাটক, সংবাদ), সিনেমা, উপন্যাস, কবিতা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রমিত বাংলা (বানান ও উচ্চারণ) শেখার সুযোগ ছিল। বর্তমানে সে সুযোগ ছিনতাই হয়ে গেছে। ডিজুস বাংলা, বাংলিশ, হালআমলের নাটক, সিনেমা যেন প্রমিত বাংলার বিনাশ সাধনে এগিয়ে চলছে নির্বিগ্নে।

এ তো গেল বানান, উচ্চারণ, বা সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের কথা; কিন্তু চেতনা? ভাষা আন্দলনের যে জাতীয় চেতনা, তথা অসাম্প্রদায়িক ও শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের যে প্রত্যয়, তা ক্রমেই যেন দূরে সরে যাচ্ছে। নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার আগে পুনরায় ধারণ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য।

ভাষা সমাজের দর্পণ। মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষায় যেমনি সংশ্লিষ্ট সমাজকে জানা যায় না, তেমনি অন্য ভাষায় প্রকৃত শিক্ষা লাভ করা দুরূহ। বাংলা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা, শিক্ষার প্রধান মাধ্যম। কিন্তু এই দেশে বাঙালি ছাড়াও আরো আনেক জাতিগোষ্ঠী রয়েছে যাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়।

তারা নিজ মাতৃভাষায় কথা বলে (যেমন, চাকমা, মারমা, পাংখোয়া, ইত্যাদি)। অন্য জাতির সাথে কথা বলার সময় তাদের হয় প্রবল জাতির ভাষায় কিংবা তৃতীয় কোনো ভাষা বা লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা যেমন বাংলায় কথা বলতে হয়। ফলে তাদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে কৃত্রিমতা আসে।

সেটি বড় সমস্যা নয়, কিন্তু তারা যখন নিজ ভাষায় শিক্ষা লাভ করা থেকে বঞ্চিত হয়, তা তাদের ভাষা, জ্ঞান, ও দক্ষতার জন্য হুমকিস্বরূপ। বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর ভাষাগত বিপন্নতার কথা বিবেচনায় নিয়ে ২০১২ সাল থেকে নৃগোষ্ঠীর জন্য তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা তথা পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। তথাপি, মাঠপর্যায়ে তা এখনো কার্যত অকার্যকর।

কারণ প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক, বই ইত্যাদির অপ্রতুলতা। মাতৃভাষার প্রতি সম্মানার্থে সবার জন্য মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সাথে সাথে দেশে বিদ্যমান ইংরেজি মাধ্যম বা ভার্সনের যে বিচিত্র শিক্ষা ব্যবস্থা তা নিয়ে গুরুত্বের সাথে ভাবা দরকার।

ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষা, সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাস কতটা সমুন্নত তা নিয়ে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ জরুরি। পৃথিবীর সকল জাতির মানুষ নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ ও কথা বলার সুযোগ পাক- এটাই আজকের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রত্যাশা।

লেখক: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়