logo
আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১০:৫৬
শুধু ফেব্রুয়ারিতেই বাংলা নিয়ে আলোচনা
শাহীন রহমান

শুধু ফেব্রুয়ারিতেই বাংলা নিয়ে আলোচনা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবহেলার কারণে বাংলা ভাষা ক্রমেই তার অভিভাবককে হারিয়ে ফেলছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ছিল আমাদের জাতিসত্তার লড়াই। সেই আন্দোলনে আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকারই অর্জিত হয়নি। এই আন্দোলনে মাঝেই ৭১ এর স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল।

যে ভাষার আন্দোলন বিশ্ব পরিসরে স্থান করে নিয়েছে। স্বীকৃতি পেয়েছে আন্তর্জাতিক পরিসরে। আন্দোলনের আঁতুর ঘরে সেই বাংলা ভাষা কতটা সুরক্ষিত? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যক্তি থেকে সমাজ, জাতি এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয়ভাবে অবহেলার শিকার হচ্ছে বাংলা ভাষা। আন্দোলনের ৭০ বছর পরও ভাষাশিক্ষার সঠিক পদ্ধতি ও কৌশল নির্ধারণ করা হয়নি জাতীয় শিক্ষাক্রমে। এভাবে অবহেলার শিকার হলে একদিন বাংলা ভাষাও তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলবে।

অথচ বিশ্বের বুকে বাংলা ভাষাই একমাত্র ভাষা যার অধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবন দিতে হয়েছে। সেই ভাষার প্রতি চমর অবহেলা দেখে কবি শামসুর রাহমান দুঃখ করে লিখেছেন, ‘তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার? উনিশ শো’ বাহন্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি/বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী। সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হ’লে আমার সত্তার দিকে/কতো নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে। এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি, এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষ মাস! তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো, বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবহেলার কারণে বাংলা ভাষা ক্রমেই তার অভিভাবককে হারিয়ে ফেলছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ছিল আমাদের জাতিসত্তার লড়াই। সেই আন্দোলনে আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকারই অর্জিত হয়নি। এই আন্দোলনে মাঝেই ৭১ এর স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল।

সাংস্কৃতিক বিকাশে একুশে ফেব্রুয়ারির কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অথচ প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই ভাষা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। অন্য মাসে ভাষা রক্ষা নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না বলেই চলে। ফ্রি স্টাইলে বাংলার সঙ্গে ইংরেজির মিশেল চলে। কোনো মহল থেকে আপত্তি ওঠে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এভাবে ভাষার ব্যবহার অব্যাহত থাকলে বাংলা তার স্বীয়তা হারাবে অচিরেই।

তবে সরকারিভাবে বাংলা ভাষার স্বকীয়তা রক্ষায় একটি নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে বলে জানা গেছে। নীতিমালা ইতোমধ্যে চূড়ান্ত হওয়ার পথে রয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভাষা গবেষণা ও পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক মো. শফিউল মুজ নবীন বলেন, বাংলা ভাষা রক্ষা ও গবেষণায় একটি নীতিমালা চূড়ান্ত করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নীতিমালা চূড়ান্ত হলে ভাষার স্বকীয়তা রক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।

বিশ্বের প্রায় ২৪ কোটি লোকের মাতৃভাষা এই বাংলা। ব্যবহারের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাভাষার অবস্থান পঞ্চম। বাংলা সাহিত্যে নোবেল এসেছে প্রায় ১১০ বছর আগে। বাংলা ভাষার অনেক কবি সাহিত্যিক আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রসিদ্ধ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসমলাম বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিয়ে গেছেন বহু আগেই। অথচ আজ মাতৃভুমেই বাংলা চরম অবহেলিত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ভূষিত হয়েছে এক অনন্য মর্যাদায়। বিশ্বের ৩০টি দেশের অন্তত ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু রয়েছে। যেখানে বাংলা ভাষা পাঠদানসহ চলে গবেষণার কাজ। বাংলাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দিয়েছে সিয়েরা লিওন।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত সেই বিখ্যাত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি ১২টি ভাষায় অনূদিত হয়ে গাওয়া হচ্ছে ভাষা দিবসের স্মরণে। সব অর্জন আজ ম্নান হয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি বাংলার প্রমিত উচ্চারণে লিখতে ও বলতে অজ্ঞতা চোখে পড়ে সর্বত্র।

এভাবে অবহেলার কারণে বিশ্ব থেকে বহু জাতিগোষ্ঠীর ভাষা চিরতরে হারিয়ে গেছে। বহু ভাষা আজ অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। ইউনেস্কোর এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতি ১৪ দিনে বিশ্বে একটি করে ভাষার মৃত্যু ঘটছে। এতে আরো বলা হয়েছে বিশ্বের প্রায় ৬ হাজার ভাষার মধ্যে ২ হাজার ৫০০ ভাষা বিপন্ন’র তালিকায় রয়েছে।

এ তালিকায় বাংলাদেশের ২৯টি ভাষাকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি ভাষা দারুণভাবে বিপন্ন। চারটিতে তারা নিশ্চিত বিপন্ন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। দুটি ভাষাকে দোদুল্যমান অর্থাৎ বিপন্ন ও নিরাপদ ভাষার মাঝামাঝি অবস্থানে দেখানো হয়েছে। আর ১৬টি ভাষার ক্ষেত্রে কোন পরিচয়ে আবদ্ধ করা হয়নি।

ভাষা বিলুপ্ত বা বিপন্ন হওয়ার কারণ হিসেবে ভাষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ফলে অনেক স্থানীয় ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী হত্যা বা নির্যাতনের শিকার হয়। এ কারণে ভাষার বিলপ্তি বা বিপন্ন হয়ে পড়ে। আবার গোষ্ঠীগত আধিপত্য বা প্রধান্য বিস্তারের ফলে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা বিলুপ্ত হয়ে পড়তে পারে।