logo
আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১১:৪৮
অনলাইন বুলিং: সময়ের কালো ছায়া
আব্দুল আলীম

অনলাইন বুলিং: সময়ের কালো ছায়া

দিন পনেরো আগের ঘটনা। একাত্তর টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও সংবাদ উপস্থাপক নাজনীন মুন্নীর অশ্লীল ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য, ভিডিওটি ছিল মিথ্যা ও বানোয়াট! অনলাইন বা সাইবার বুলিং তথা ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে দুর্বৃত্তায়ন কিংবা হেনস্থার এ জাতীয় ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এহেন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে নিয়মিত বিরতিতে সামনে আসছে।

গত বছর অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী অনলাইনে হেনস্থার শিকার হন। মা দিবসে চঞ্চল চৌধুরীর পোস্ট করা তার মায়ের ছবির নিচে একেকজন সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করতে থাকে। অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য-পাল্টা মন্তব্যে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম সয়লাব হয়ে ওঠে। সে সময় আক্রমণের শিকার হন বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের সাবেক ক্রিকেটার, উপস্থাপক ও অভিনয়শিল্পী মিশু চৌধুরী। একই বছর অভিনয়শিল্পী আশনা হাবিব ভাবনা গণমাধ্যমে খবরের শিরোনাম হন। তিনিও মা দিবসে মা ও বোনের সঙ্গে একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে মাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। মা-মেয়ের পবিত্র সম্পর্কের পোস্টের নিচে এসে জড়ো হয় বহু অশালীন মন্তব্য! সম্প্রতি অনলাইনে হেনস্থার শিকার হন নায়িকা পরীমনি। তিনি কয়েকজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ করলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার বিভিন্ন পোস্টে অকথ্য মন্তব্যের ঝড় ওঠে। পরীমনির আনীত অভিযোগের বিষয়টি ছাপিয়ে অনলাইনে তার খোলামেলা ছবি নিয়ে সমালোচনা আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। এর আগে ২০১৯ সালে অপপ্রচারের আশঙ্কা ও সাইবার নিরাপত্তাহীনতার কবলে পড়েন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়। তাকে হেনস্থা করতে তার নামে ফেসবুকে ৪০টির বেশি ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলে দুর্বৃত্তরাউপরিউক্ত ভুক্তভোগীদের মতো অনেকেই অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বুলিং ও হেনস্থার শিকারে পরিণত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এ জাতীয় ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রভাবশালী লোকজন কিংবা সমাজে কিছুটা হলেও প্রভাব আছে এমন সব ব্যক্তিই অনলাইন বুলিংয়ের শিকার হন বেশি। প্রতিদিন ঠিক কত মানুষ অনলাইন বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই।

তবে নারী ও শিশু-কিশোররা এতে বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে বিভিন্ন জরিপ বলছে। ইন্টারনেটে ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে, ফেসবুক আইডি হ্যাক করে হুমকি-ধমকি দিয়ে অর্থ আদায়, ছবি বা ভিডিও এডিট করে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি, সুপার এডিটিং ছবি, পর্নোগ্রাফি, ছবি দিয়ে আপত্তিকর কনটেন্ট বা ফেক আইডি তৈরি, ফোন নম্বর ছড়িয়ে দেওয়া, হয়রানিমূলক এসএমএস, মেইল বা লিংক পাঠানোসহ বিভিন্ন উপায়ে অনলাইন বুলিং তথা এসব হয়রানি করা হচ্ছে বলে জরিপে উঠে এসেছে।

আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থার ‘মহাসড়ক’ হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে ইন্টারনেট বা অনলাইন স্পেস। গবেষণা মতে, দেশে প্রতি ১২ সেকেন্ডে ফেসবুকে একজন নতুন ব্যবহারকারী যুক্ত হচ্ছেন, যা দেশের জন্মহারের চেয়েও বেশি। আধুনিক যুগের দৈনন্দিন কাজকর্ম বেশিরভাগই অনলাইননির্ভর। উপরন্তু, অনলাইনের সুবিশাল পরিসরে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে সাইবার বুলিংয়ের ঝুঁকি এখন বেশ উদ্বেগজনক। পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে থাকে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে নিয়মিত সাইবার বুলিং, আপত্তিকর মন্তব্য কিংবা হয়রানির শিকার হয়। বিশেষ করে নারী ও শিশু-কিশোররা এতে বেশি হয়রানি হচ্ছে বলে বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে। অন্যদিকে, বাস্তব জীবনে ঘটমান অপরাধগুলো এখন ডিজিটাল মাধ্যমে স্থানান্তরিত হচ্ছে।

অনলাইন বুলিংয়ের ফলে হয়রানির শিকার হওয়া সংক্রান্ত পরিসংখ্যানগুলো বেশ অস্বস্তিজনক। এসব পরিসংখ্যানে নারী ও শিশুদের নিয়ে উদ্বেগজনক তথ্য-উপাত্ত সামনে আসছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত পাঁচ বছরে অনলাইন ক্রাইম বিষয়ে যত মামলা হয়েছে, তা বিশ্লেষণে দেখা যায়’ ভিকটিমদের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগই নারী। চিন্তার বিষয় হলো, এসব নারীর বেশির ভাগই উঠতি বয়সী তরুণী বা যুবতী। শিশুদের সংখ্যাও চোখে পড়ার মতো।

পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, পর্নোগ্রাফি কন্ট্রোল অ্যাক্ট, আইসিটি অ্যাক্ট, টেলিকমিউনিকেশন অ্যাক্ট' এসব আইনে এ পর্যন্ত যত মামলা হয়েছে তার অধিকাংশ ঘটনার ভিকটিম বা শিকার নারীর বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছর। হিসাব বলছে, দেশে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া ৩৮ শতাংশ মানুষের বয়স ১০ থেকে ১৩ বছর; ৩৬ শতাংশের বয়স ১৪ থেকে ১৫ বছর এবং ২৫ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ১৭ বছর।

জাতিসংঘ শিশু তহবিল ও ইউনিসেফ বাংলাদেশ-এর ‘বাংলাদেশের শিশুদের অনলাইন নিরাপত্তা’ শীর্ষক সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, দেশের ৩২ শতাংশ শিশু অনলাইনে সহিংসতা, ভয়ভীতি ও উৎপীড়নের শিকার হয়েছে। জরিপ মতে, ৭০ শতাংশ ছেলে ও ৪৪ শতাংশ মেয়ে অনলাইনে অপরিচিত মানুষের বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করে। ১৪ শতাংশ ইন্টারনেটে পরিচয় হওয়া ‘বন্ধুদের’ সঙ্গে সরাসরি দেখা করেছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৯ শতাংশ শিশু ধর্মীয় উসকানিমূলক বিষয়বস্তুর মুখোমুখি হওয়ার কথা জানিয়েছে।

বুলিংয়ের ফলাফল অত্যন্ত ভয়াবহ। বুলিং ভুক্তভোগীকে মারাত্মক পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। বুলিংয়ের ফলে ভুক্তভোগীর দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। মানসিকতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে যারা জানে না বুলিং কি বা কীভাবে এর মোকাবিলা করতে হয়, তাদের বড় একটা অংশ হতাশায় ভোগে। বুলিং তাদেরকে সামাজিকভাবে, মানসিকভাবে একা করে ফেলে। বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে তারা নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয় কিংবা নিজেকে আড়াল করে চলে। বিষণ্মতায় পড়ে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে নিজের যোগ্যতাকে দোষারোপ করে।

বুলিংয়ের ফলাফল অত্যন্ত ভয়াবহ। বুলিং ভুক্তভোগীকে মারাত্মক পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। বুলিংয়ের ফলে ভুক্তভোগীর দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। মানসিকতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে যারা জানে না বুলিং কি বা কীভাবে এর মোকাবিলা করতে হয়, তাদের বড় একটা অংশ হতাশায় ভোগে। বুলিং তাদেরকে সামাজিকভাবে, মানসিকভাবে একা করে ফেলে। বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে তারা নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয় কিংবা নিজেকে আড়াল করে চলে। বিষণ্মতায় পড়ে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে নিজের যোগ্যতাকে দোষারোপ করে। ভীতসন্ত্রস্ততা, খিটখিটে মেজাজ এবং নিজেকে হেয় করে দেখার প্রবণতাও দেখা দেয়। একপর্যায়ে দৈনন্দিন কাজকর্মে অনীহা তৈরি হয়। ক্রমাগত বুলিংয়ের সম্মুখীন হয়ে অনেকে আত্মহত্যার চিন্তা করে, কেউ কেউ আত্মহত্যার চেষ্টাও করে। বুলিংয়ের শিকার হয়ে মানসিক অবসাদ থেকে আত্মহত্যার ঘটনা সময়ে সময়ে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়।

ডিউক ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের সহকারী অধ্যাপক উইলিয়ামস কোপল্যান্ডের মতে, বুলিংকারীদের ক্ষেত্রে এন্টি-সোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের হার অন্য যে কোনো গোষ্ঠীর থেকে বেশি। এরা অপরের প্রতি কম সহানুভ‚তিশীল। এদের মধ্যে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ বা হিরোইজম প্রমাণের একটি প্রেরণা থেকেই মূলত বুলিং করে থাকে। এরা একবারও ভেবে দেখে না বুলিং অভিজ্ঞতা ভুক্তভোগীর জন্য কত বড় মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে বা তাদেও ওপর এর কি প্রভাব পড়তে পারে!

ইন্টারনেটের এই বিপ্লবের যুগে অনলাইনকেন্দ্রিক অপরাধকে জটিল এক মনস্তাত্ত্বিক উপদ্রব হিসেবে দেখছেন সাইবার অপরাধ নিয়ে কর্মরত সংশ্লিষ্টরা। মোটা দাগে তাদের পরামর্শ হলো- ‘নিজেকে বোঝাতে হবে, এটি আপনার দোষ নয়।’ আশার কথা হলো, দেশে অনলাইন বুলিং থেকে প্রতিকার পাওয়ার বিভিন্ন জায়গা তথা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। নারীরা যাতে সহজে অভিযোগ জানাতে পারেন, সে জন্য ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ উদ্যোগটিতে পুলিশের নারী সদস্যরা অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত এবং পরামর্শ দেওয়াসহ সব দায়িত্ব পালন করছেন।

অনলাইনে সহিংসতা ও সাইবার হয়রানির শিকার হলে আইনি সহায়তা নেওয়ার জন্য কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন, সাইবার পুলিশ সেন্টার, হ্যালো সিটি অ্যাপ, রিপোর্ট টু র‌্যাব অ্যাপ, ৯৯৯ এবং এসব সংস্থার ফেসবুক পেজে অভিযোগ জানানো যায়। শিশুদের সহায়তায় ১০৯৮ নম্বরে, নারী ও শিশুদের সহায়তায় ১০৯ হটলাইনে ফোন করেও সেবা নেওয়া যায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর অনলাইন নিরাপত্তার বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। ইন্টারনেট নিরাপদ করতে সরকার পর্নো সাইট, জুয়া খেলার সাইট বন্ধ করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।

২০১৯ সালের আগস্ট মাসে শিশুদের নিরাপদ ইন্টারনেট দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে শিশুদের জন্য ক্ষতিকর, অশ্লীল, আপত্তিকর ওয়েবসাইট ও হরর গেম বন্ধে কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না, তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। অর্থাৎ বসে ইেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতও।

এসব উদ্যোগের বেশ সুফলও মিলছে। সাম্প্রতিক প্রকাশিত সাইবার নিরাপত্তা সূচকে আগের ৭৩তম অবস্থান থেকে ৬৫তম স্থানে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। তবে এতসব উদ্যোগ সত্তে¡ও পরিতাপের বিষয় হলো, অনলাইন বুলিং নিয়ে সর্বসাধারণের মধ্যে কাক্সিক্ষত সচেতনতা তৈরিতে পিছিয়ে আছি আমরা।

দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, সহিংসতার শিকার হলেও অভিযোগ করার বিষয়ে সচেতন নন বেশির ভাগ নারী। কাজেই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তিসচেতনতা সৃষ্টিতে মনোযোগী হতে হবে সবাইকে।

ইন্টারনেটের দুনিয়ায় প্রতিনিয়ত যেমন বাড়ছে সম্ভাবনা, তেমনি এর ভুল ব্যবহাওে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের অনিরাপত্তা। একটু সতর্কতা অবলম্বন করে চললেই নিরাপদ থাকা সম্ভব। এক্ষেত্রে ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে জানতে হবে সর্বাগ্রে। আর অনলাইনের সীমাহীন জগতে প্রবেশের আগে আমাদের মাথায় রাখতে হবে’ ‘কখন চলতে হবে এবং কোথায় থামতে হবে।’

লেখক : প্রোগাম অর্গানাইজার। ইউডিপি, ব্র্যাক