সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতার মূল উৎপাটনের দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজররা। তারা বলেছেন, দ্বিজাতিতত্ত্বের মৃত্যু ঘটলেও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এখনো স্বাধীন বাংলাদেশে বিরাজমান। এই অপশক্তি সুযোগ পেলেই সংখ্যালঘুদের উপর আঘাত করে। বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে দ্রুত ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন’ অবিলম্বে করতে হবে যেন সন্ত্রাসীরা এমন বীভৎস হামলার সাহস না পায়।
গত সোমবার ভাষা শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ‘আমাদের ভাষা আন্দোলন সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের মৃত্যুবার্তা’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারের আয়োজন করে। এতে অংশ নিয়ে বিশিষ্টজনরা এসব কথা বলেন।
সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘এই উপমহাদেশে ১৮৬৭ সালে উত্তর ভারতের হিন্দি-উর্দু বিরোধ জন্ম দিয়েছিল সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের। ১৯৪৮-এর বাংলা-উর্দু বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটেছে এই সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের সমাধি রচনার মাধ্যমে। পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির অভিব্যক্তি ছিল রাজনৈতিক ইসলাম। দেশটির ২৪ বছরের উপনিবেশসুলভ শাসনামলে দেখেছি- ইসলামের নামে জাতিগত নিপীড়ন, শোষণ, হত্যা ও সন্ত্রাস সহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ এমনকি গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধকেও কীভাবে জায়েজ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে পরাজয় ঘটলেও স্বাধীন বাংলাদেশে পরাজিত রাজনৈতিক ইসলাম আবার ব্রাম স্টোকারের পিশাচ কাহিনী ড্রাকুলার মতো কবর থেকে উঠে এসেছে। রক্তপানের জন্য বেছে নিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক মানবতার বোধকে। বাঙালিত্বের যে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ১৯৪৮-এ ভয় পেয়েছিলেন জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী, ১৯৭১-এ ভয় পেয়েছেন, ইয়াহিয়া ও গোলাম আযমরা- সেই চেতনার আলোই বধ করবে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারকারী সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে।’
মানবাধিকার নেত্রী আরমা দত্ত এমপি বলেন, ‘’৭১-এ ভাষার উপর ভিত্তি করে যে জাতিরাষ্ট্র গঠিত হয়েছে তা পৃথিবীতে অনন্য। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষার জন্য তৎকালীন পাকিস্তানের সংসদে দাঁড়িয়ে একা যে অসামান্য লড়াই চালিয়েছিলেন তা তিনি শুধুমাত্র মাতৃভাষা ও বাঙালি জাতির আত্মমর্যাদা ও আত্মপরিচয়ের চিহ্নকে রক্ষা করার জন্য, তা খ্যাতির জন্য নয়। আমরা যেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সেই স্বপ্ন ও প্রত্যাশাকে জাগরুক রাখতে পারি।’
শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের আত্মদানের কারণে শুধু ভাষার অধিকার ফিরে পেয়েছি তাই নয়, প্রকৃতপক্ষে আমরা ফিরে পেয়েছি একটি জাতি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার গৌরব এবং মর্যাদা। তাদের ঋণ অপরিশোধ্য। প্রতিক্রিয়াশীল নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেছিলেন, আমাদের সংগ্রাম ভারত সরকারের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দুদের বিরুদ্ধে। তাদের এই ভাবাদর্শের পরিণাম দেশবাসী দেখেছে। দেশভাগের ফলে পাকিস্তান ও ভারতে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা চরম রূপ ধারণ করেছিল। জীবন বাঁচাতে পৃথিবীর বৃহত্তম দেশান্তর তখন সংঘটিত হয়। ব্রিটিশদের বিভাজন ও শাসন নীতির ফলে সৃষ্টি এই ভয়াবহতায় প্রায় দেড় কোটি লোক বাস্তুচ্যুত হন।
শিক্ষাবিদ মমতাজ লতিফ বলেন, ‘বাংলা ভাষা আন্দোলন সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের মৃত্যুবার্তা বা মৃত্যু ঘটালেও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এখনো স্বাধীন বাংলাদেশে বিরাজমান। এই সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সুযোগ পেলেই সংখ্যালঘুদের উপর আঘাত করে। আমি চাই বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে দ্রুত ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন’ অবিলম্বে করতে হবে যেন সন্ত্রাসীরা এমন বীভৎস হামলার সাহস না পায়।’
প্রজন্ম ’৭১-এর সভাপতি আসিফ মুনীর তন্ময় বলেন, বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস হিসেবে ধারাবাহিকভাবে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনসহ সকল আন্দোলনের ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে, গবেষণায়, সাহিত্যে ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হতে হবে।’
নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের দাবি পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা যেভাবে আবার মাথাচাড়া দিচ্ছে- তরুণ প্রজন্মকে এর অশুভ প্রভাব থেকে দূরে রাখতে হলে অসাম্প্রদায়িক মানবিকতার চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে।’