logo
আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৯:০৬
আফিফ-মিরাজ বীরত্বে বাংলাদেশের জয়
মাহমুদুন্নবী চঞ্চল

আফিফ-মিরাজ বীরত্বে বাংলাদেশের  জয়

এক কথায় অবিশ্বাস্যই। ১৮ রানে নেই টপ অর্ডারের চার ব্যাটার। ৪৬ রানে উইকেট পতন ৬টি। জিততে হলে করতে হবে ২১৬ রান। ঘরের মাঠে এমন স্কোর মামুলি মনে হলেও তখন তা হিমালয় সমান। চোখ রাঙাচ্ছিল বড় ব্যবধানে হার। কিন্তু সেই ধ্বংস্তূপের মধ্য থেকে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠলেন আফিফ ও মিরাজ। অটল চিত্তে দাঁড়িয়ে গেলেন ২২ গজের কমব্যাট জোনে। লড়াই করলেন আফগান বোলারদের বিরুদ্ধে। বুক চিতিয়ে, অসীম সাহসে, অফুরন্ত রোমাঞ্চ ছড়িয়ে। খেললেন ক্যারিয়ার সেরা বীরোচিত ইনিংস। হলো সপ্তম উইকেটে রেকর্ড। প্রবল ঘাম ছুটে অবশেষে এলো প্রশান্তির এক জয়।

চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে প্রথম ওয়ানডেতে আফগানিস্তানকে ৪ উইকেটে হারিয়েছে বাংলাদেশ। কথাটি যতটা সহজে লেখা হলো, মাঠের সেই কাজটি ছিল ভীষণ কঠিন ও দুরুহ। বীরত্বমাখা ইনিংস খেলে সেই কাজটি সম্পন্ন করেন দুই উঠতি তারকা মিরাজ ও আফিফ। অবিচ্ছিন্ন ১৭৪ রানের রেকর্ডময় জুটিতে আসে সেই কাঙ্ক্ষিত জয়ের মূহূর্ত। ২১৬ রানের লক্ষ্য বাংলাদেশ স্পর্শ করে সাত বল হাতে রেখে। ম্যাচ সেরা মিরাজ, কিন্তু সবার চোখে আফিফও। তিনি জেতেন ম্যাচের সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়ের পুরস্কার। রোমাঞ্চকর জয়ে তিন ম্যাচ সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল টিম টাইগার্স।

টস পর্বটা জিতেছিল আফগানিস্তান। আগে ব্যাট করতে নেমে সুবিধা করতে পারেনি সফরকারীরা। বল হাতে সুরটা বেঁধে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের বোলাররা। ২১৫ রানে আটকে রাখা যায় আফগানদের। জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের আরেক নাম সাগরিকা। সাগরিকার উইকেট ব্যাটিং সহায়ক। এমন টার্গেট বাংলাদেশ হেসে খেলে স্পর্শ করবে, এমনটাই ছিল অনুমেয়। তবে বল হাতে বাংলাদেশ শিবিরে শুরুতে ধ্বংসযজ্ঞ চালান তরুণ আফগান পেসার ফজল হক ফারুকি। অথচ এই পেসারকে বলতে গেলে গোনায় ধরেনি স্বাগতিক শিবির। যা পরিকল্পনা ছিল আফগান স্পিনত্রয়ীকে নিয়ে। কিন্তু ১৮ রানের মধ্যে বাংলাদেশের চার ব্যাটারকে ফিরিয়ে আফগান শিবিরে আগাম জয়ের উপলক্ষ বয়ে আনেন ফারুকি।

বল হাতে তার আঘাত শুরু ইনিংসের তৃতীয় ওভার থেকে। উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন লিটন দাস। আম্পায়ার যদিও প্রথমে আউট দেননি। রিভিউ নিয়ে সফল হয় আফগানিস্তান। ৮ বলে লিটন করতে পারেন মাত্র এক রান। একই ওভারের পঞ্চম বলে বিদায় নেন অধিনায়ক তামিম ইকবাল। ৮ বলে দুই চারে ৮ রান করে তিনি ফারুকির এলবিডব্লিউর শিকার। এবারো আম্পায়ার আগে আঙুল তোলেননি। রিভিউ নিয়ে সফল আফগানিস্তান। একই ওভারে দুই রিভিউ নিয়ে বাংলাদেশের দুই ওপেনারকে ফেরায় আফগানরা।

শুরুর বিপর্যয় রোধ করতে পারেননি অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহীমও। ফারুকির পঞ্চম ওভারের প্রথম বলে তিনি এলবিডব্লিউ’র শিকার। রিভিউ নেন মুশফিক। কাজে দেয়নি। রিপ্লেতে দেখা যায় বল লাগত অফ মিডল স্টাম্পে। ৫ বলে মুশফিক করতে পারেন মাত্র তিন রান। একই ওভারের শেষ বলে আবার ফারুকি ঝলক। এবার তিনি বোল্ড করেন দেন অভিষিক্ত ইয়াসির আলী রাব্বিকে। ৫ বল খেলেও রানের খাতা খুলতে পারেননি রাব্বি। অভিষেকটা তাই বিষাদের হয় তরুণ এই ব্যাটারের। ১৮ রানে চার উইকেট হারিয়ে চরম বিপদে তখন বাংলাদেশ।

সাকিব ও মাহমুদউল্লাহ চেষ্টা করেন প্রতিরোধ গড়তে। কিন্তু সেটাও বেশিক্ষণ টেকেনি। স্পিনার মুজিব উর রহমানের বলে বিদায় নেন সাকিব (১৫ বলে ১০ রান)। হয়ে যান বোল্ড। ২৮ রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে দিকহারা বাংলাদেশকে পথ দেখানোর চেষ্টায় তখন মাহমুদউল্লাহ ও আফিফ হোসেন। রক্ষণাত্মক ব্যাটিংয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন দুজন। তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। ১২তম ওভারে রশিদ খানের স্পিন ঘূর্ণি। ১৭ বলে ৮ রান করে গুলবাদিনের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন সাইলেন্ট কিলার মাহমুদউল্লাহ। ৪৫ রান তুলতেই শেষ বাংলাদেশের ৬ উইকেট। জয়ের অপেক্ষায় আফগানিস্তান।

কিন্তু এরপরই দুরন্ত প্রত্যাবর্তনের গল্প লেখেন দুই তরুণ মিরাজ ও আফিফ। দেখে-শুনে চালাতে থাকেন ব্যাট। জমতে শুরু করে জুটি। শেষ পর্যন্ত যা হয়, তা এক দারুণ ইতিহাস। অবিচ্ছিন্ন থেকেই দুজন জেতান বাংলাদেশকে। ৪৯তম ওভারে গুলবাদিনকে সপাটে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে জয়োল্লাসে মাতেন আফিফ। সঙ্গে মিরাজ, গোটা বাংলাদেশও।

১৭৪ রানের সপ্তম উইকেট জুটিতে হয়েছে রেকর্ড। আর মাত্র চার রান হলেই হতো সপ্তম উইকেটে বিশ্বরেকর্ড। সেটা না হলেও রান তাড়ায় কিংবা দ্বিতীয় ইনিংসে এটি বিশ্বরেকর্ড। কাব্যিক জুটিতে মিরাজ ও আফিফ দুজনই খেলেছেন ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস। যার ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ছিল না একটি ফিফটি, সেই আফিফ অপরাজিত থাকেন ৯৩ রানে। ১১৫ বলের ইনিংস তিনি সাজান ১১টি চার ও একটি ছক্কায়। ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস মিরাজেরও। আগে ছিল ৫১। দ্বিতীয় ফিফটিতে তিনি অপরাজিত থাকেন ৮১ রানে। ১২০ বলের ইনিংসে তার বাউন্ডারি ৯টি।

এত অল্প রানে ৬ উইকেট হারিয়ে যাওয়ার পর ম্যাচ জেতেনি কখনো বাংলাদেশ। এদিক থেকেও নতুন রেকর্ড এটি। এর আগে সবচেয়ে কম রানে ৬ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশের জেতার রেকর্ডটি ছিল ২০০৬ সালের। কেনিয়ার বিপক্ষে নাইরোবিতে ১৮৪ রান তাড়ায় ১১২ রানে ৬ উইকেট হারানোর পরও বাংলাদেশ জিতেছিল নবম উইকেটে মাশরাফি বিন মুর্তজা ও আব্দুর রাজ্জাকের ৫০ বলে ৫১ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে। সপ্তম উইকেটে বাংলাদেশের আগের সর্বোচ্চ রান ছিল ইমরুল কায়েস ও সাইফউদ্দিনের, ১২৭। মিরাজ-আফিফে তা ছিটকে গেল এদিন।

এর আগে ব্যাট করতে নামা আফগানিস্তান শুরু থেকেই ছিল অস্বস্তির মধ্যে। বাংলাদেশের বোলারদের দারুণ বোলিংয়ে চ্যালেঞ্জিং স্কোর হয়নি তাদের। সর্বোচ্চ ৬৭ রানের ইনিংস আসে নাজিবুল্লাহ জাদরানের ব্যাট থেকে। রহমত শাহ করেন ৩৪। অধিনায়ক হাসমতউল্লাহর ব্যাটে আসে ২৮ রান। বল হাতে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ৩ উইকেট নেন মোস্তাফিজুর রহমান। ৯.১ ওভারে মাত্র ৩৫ রান দেন তিনি। তবে সবচেয়ে কম ইকোনমি শরিফুলের। ১০ ওভারে এক মেডেনে ৩৮ রানে তিনি নেন দুটি উইকেট। সাকিব ও তাসকিন একটু মার খেলেও নেন দুটি করে উইকেট। এক ওভার বল করে মাহমুদউল্লাহ পান এক উইকেট।

ম্যাচ শেষে বাংলাদেশ কাপ্তান তামিম বিস্ময়ের সুরে বলেন, ‘ভাবিনি জিততে পারব।’ কিন্তু সেই অসাধ্য কাজটি সাধন করেছেন মিরাজ-আফিফ। সতীর্থদের প্রশংসার বৃষ্টিতে ভাসছেন দুজন। আগামীকাল দ্বিতীয় ওয়ানডে এই চট্টগ্রামে। সব দিন লোয়ার অর্ডারের ব্যাটাররা দাড়িয়ে যাবেন, এমনটি ভাবা বোকামি। দাপুটে জয়ের জন্য চাই টপ অর্ডারদের ঝলসে ওঠা। সেটারই অপেক্ষায় তামিম ব্রিগেড।