logo
আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০৫
শুরু হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন
অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

শুরু হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন

দেশের সবাইকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় আনার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। সর্বজনীন এ পেনশনের অধীনে যিনি যেমন কন্ট্রিবিউট করবেন, তিনি তত পেনশন ভোগ করতে পারবেন। এ জন্য শিগগিরই সরকারের সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করবে। আগামী ৬ মাস থেকে এক বছরের মধ্যে কার্যক্রম শুরু হবে। গতকাল বুধবার অর্থনৈতিকবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ বিষয়ে বিস্তারিত জানান অর্থমন্ত্রী।

সরকারের উদ্যোগকে যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, সরকারি, আধাসরকারি ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কিছু মানুষ ছাড়া পেনশনের আওতার বাইরে আছে। ৬৫ বছরের ওপরে অনেকেই সামাজিক সুরক্ষার কর্মসূচির আওতায় প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন না। এর বাইরে বিপুল সংখ্যক মানুষ সামাজিক সুরক্ষার বাইরে আছেন। সরকার ঘোষিত সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রম শুরু হলে সব মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে আসবে।

এই পদ্ধতিতে পেনশন পেতে আগ্রহীদের প্রতি মাসে টাকা জমা করতে হবে। বেশি বছর ধরে টাকা জমা করলে পেনশনের পরিমাণ বেশি হবে। একজনকে সর্বনিম্ন ১০ বছর টাকা জমা করতে হবে। নিম্ন আয়ের মানুষের জমা করা টাকার একটি অংশ দিতে পারে সরকার। সর্বজনীন যে পেনশন ব্যবস্থা চালু হচ্ছে তাতে মাসে এক হাজার টাকা জমা করলে ৬০ থেকে ৮০ বছর পর্যন্ত ২০ বছর প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ৬৪ হাজার ৭৭৬ টাকা পেনশন পাওয়া যাবে। এই পরিমাণ পেনশন পেতে সেই ব্যক্তিকে ১৮ বছর বয়স থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত প্রতি মাসে এই চাঁদা জমা দিতে হবে।

বার্ষিক ১০ শতাংশ মুনাফা ও আনুতোষিক ৮ শতাংশ ধরে এই হিসাব করা হয়েছে। কেউ ৮০ বছরের বেশি বেঁচে থাকলে তার ক্ষেত্রে হিসাবটা কত হবে, সেটি এখনো জানানো হয়নি। তবে তিনি যত দিন বেঁচে থাকবেন, ততদিনই পেনশন পাবেন। আর এই ৮০ বছর ধরা হয়েছে দেশে গড় আয়ু ৭৩ বছর ধরে। ২০৭৫ সালে এটি ৮৫ হবে বলে ধরে নেওয়া হয়েছে।

কেউ ৭৫ বছর বয়সের আগে মারা গেলে জমাকারীর বছর ৭৫ হওয়া পর্যন্ত তার নমিনি পাবেন এই পেনশন। এই পদ্ধতিতে পেনশন পেতে আগ্রহীদের প্রতি মাসে টাকা জমা করতে হবে। বেশি বছর ধরে টাকা জমা করলে পেনশনের পরিমাণ বেশি হবে। একজনকে সর্বনিম্ন ১০ বছর টাকা জমা করতে হবে।

১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সি সব কর্মক্ষম নাগরিক সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারবেন; জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে নাগরিকরা পেনশন হিসাব খুলবেন। প্রথমে এটি স্বেচ্ছাধীন থাকলেও পরে বাধ্যতামূলক করা হবে। ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিলে মাসিক পেনশন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন হবে।

কেউ যদি ৩০ বছর বয়সে টাকা জমানো শুরু করেন এবং তিনি যদি মাসে এক হাজার টাকা জমান, তাহলে তার পেনশন কমে হবে ১৮ হাজার ৯০৮ টাকা। কেউ চাইলে এর চেয়ে বেশি চাঁদা জমা করতে পারবেন। এটি একটি আনুমানিক হিসাব। প্রকৃত অবস্থা আইন ও বিধি প্রণয়ন এবং পেনশন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার পর বিস্তারিত জানা যাবে।

যাদের পক্ষে এই পরিমাণ অর্থ জমানো সম্ভব হবে না, তাদের আর্থিক সহায়তা করবে সরকার নিজেই। পেনশন তহবিলে টাকা জমা পড়বে, তার বার্ষিক মুনাফা ১০ শতাংশ ও আনুতোষিক ৮ শতাংশ ধরে এই হিসাব করা হয়েছে। পেনশন স্কিমে টাকা জমার হার নির্দিষ্ট নয়। কেউ তার সামর্থ্য অনুযায়ী টাকা জমা করবে। নিম্ন আয়সীমা নিচের নাগরিকদের ক্ষেত্রে পেনশন স্কিমে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারে। পেনশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের যে খরচ হবে, সেটি বহন করবে সরকার।

সবার জন্য পেনশন আওয়ামী লীগের গত আমলের চিন্তা। আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকাকালে ২০১৭-১৮ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে তিনি একটি রূপরেখা দিয়েছিলেন। এ জন্য পাইলট প্রকল্পের কথা বলেছিলেন তিনি। সর্বশেষ বিষয়টি স্পষ্ট হলো গত ১৭ ফেব্রুয়ারি। সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তন’ বিষয়ে একটি উপস্থাপনা দেয় অর্থ বিভাগ। এরপর প্রধানমন্ত্রী ষাটোর্ধ্ব জনগণের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রণয়ন এবং কর্তৃপক্ষ স্থাপনের নির্দেশ দেন। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার আলোকে বিভিন্ন নির্দেশনার পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে আইন করার উদ্যোগ নিতে অর্থ বিভাগকে নির্দেশ দেন তিনি।

সরকারের এই উদ্যোগকে ঘোষণা হিসেবে ভালো মনে করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, সরকারি কর্মচারী বা করপোরেট কর্মচারী বাদে আর যারা আছেন, তারা এ ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। সেখানে যদি আমরা বাধ্যতামূলক একটি স্কিম করতে পারি তাহলে সেটা একটি ভালো উদ্যোগ হবে। সে ক্ষেত্রে এর বিভিন্ন দিকগুলো নিয়ে হিসাব-নিকাশ করতে হবে। এ জন্য প্রথমে পাইলট এবং পরবর্তী সময়ে বাধ্যতামূলক কার্যক্রমে যেতে হবে। তখন সরকারের একটি কন্ট্রিবিউট থাকবে, পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তাদের কর্মীর জন্য একটি কন্ট্রিবিউট থাকবে। এ সব প্রতিষ্ঠান থেকে যে কন্ট্রিবিউট থাকবে সেখান থেকে তহবিল এসে পেনশন তহবিলে জমা হতে থাকবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, পেনশনের জন্য নির্ধারিত বয়সসীমা পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জীভূত লভ্যাংশসহ জমার বিপরীতে নির্ধারিত হারে পেনশন বিতরণযোগ্য হবে। পেনশন স্কিমে জমা অর্থ কোনো পর্যায়ে এককালীন উত্তোলনের সুযোগ থাকবে না। তবে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জমাকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে তোলা যাবে, যা সুদসহ পরিশোধ করতে হবে। তবে এই পেনশন কীভাবে দেওয়া হবে, সে বিষয়ে পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠনের পর নির্ধারণ করা হবে।

চাঁদা হিসেবে বেশি টাকা দিলে, তিনি বেশি সুবিধা পাবেন। তাহলে সরকারি চাকরিজীবী বা করপোরেট কর্মী নন, এমন বিত্তশালী বেশি কন্ট্রিবিউট করে বেশি সুবিধা নিতে চাইবে। এটা রোধ করতে সর্বজনীন পেনশন পাইলট প্রকল্পের অধীন সংগৃহীত জ্ঞান ও দেশে-বিদেশে প্রচলিত এ ধরনের কার্যক্রম থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা দিয়ে সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রম চূড়ান্ত করার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।