logo
আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৪:০১
যারা পড়ে না তারা পৃথিবীকে কিছু দিতে পারবে না: মুহম্মদ জাফর ইকবাল
নিজস্ব প্রতিবেদক

যারা পড়ে না তারা পৃথিবীকে কিছু দিতে পারবে না: মুহম্মদ জাফর ইকবাল

মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ফাইল ছবি

সময়ের জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। শিশু-কিশোরদের কাছে তিনি বেশি জনপ্রিয়। বড়দের কাছেও তার গ্রহণযোগ্যতা সমান তালে। পাঠকদের ভালোবাসার কারণে তিনি তাদের (পাঠক) সঙ্গেই সময় কাটাতে পছন্দ করেন। বর্তমানে চলছে বাঙালির প্রাণের উৎসব একুশে গ্রন্থমেলা। মেলায় প্রায় প্রতিদিনই দেখা মেলে এই কথাশিল্পীর। তার সঙ্গে কথা হয় ভোরের আকাশের। পাঠকদের জন্য তার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ইফ্ফাত শরীফ।

ভোরের আকাশ: আপনার বড় ভাই জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। তার সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?

জাফর ইকবাল: তিনি এমন একজন লেখক যার সম্পর্কে মূল্যায়ন করা কঠিন। পৃথিবীতে এমন কোনো বাঙালি পাওয়া যাবে না যার বাসায় হুমায়ূন আহমেদের বই নেই। লেখার মাধ্যমে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরেছেন। যখন আমি দেখি হুমায়ূন আহমেদ একজন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক ছিলেন তখন খুব ভালো লাগে।

যখন বাংলাদেশে রাজাকার নামটা উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ ছিল তখন সে একটা টিভিতে নাটক লিখেছিল যেখানে একটা টিয়া পাখি বলছিল ‘তুই রাজাকার’। তার বই পড়ে কত তরুণ যে অনুপ্রাণিত হয়েছে। কত যে গবেষণা হয়েছে তাতে আমার অনেক গর্ব হয়।

ভোরের আকাশ: আপনাদের বাড়িতে বই পড়ার সুন্দর একটি পরিবেশ ছিল যা আপনি অনেক সাক্ষাৎকারে বলেছেন। সে সম্পর্কে যদি নতুন করে কিছু বলেন?

জাফর ইকবাল: আমি এমন একটা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি যেখানে পড়াশোনার জন্য কখনো চাপ দেওয়া হয় না। আমরা এমন জায়গায় ছিলাম যেখানে স্কুল পর্যন্ত ছিল না। কিন্তু আমার বাবা-মা এ বিষয়ে কখনো দুশ্চিন্তা করেননি। কাজেই আমরা কোনো রকম চাপ ছাড়াই বড় হয়েছি। আর আমার বাবা ছিলেন একজন সৎ পুলিশ অফিসার।

আমাদের বিলাসিতা বলতে ছিল বই। বাসাভর্তি ছিল বই আর বই। তাই আমরা ছোটবেলা থেকে বই পড়তে পড়তে বড় হয়েছি। হুমায়ূন আহমেদ যে এত সুন্দর বই লিখতেন তার কারণ একটাই সে ছোটবেলায় এত বই পড়েছে যে ভালো না লিখে উপায় নেই। যেহেতু আমরা এমন একটা পরিবারে বড় হয়েছি স্বাভাবিকভাবেই আমাদের লেখাটা একটু ভালো হবেই।

ভোরের আকাশ: এখনকার প্রজন্মের প্রতি আপনার প্রত্যাশা কি?

জাফর ইকবাল: আমাদের প্রজন্মে যারা ছিল তারা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছি। যারা নিজের চোখে যুদ্ধ দেখেনি তারা কল্পনাও করতে পারবে না। একই সঙ্গে আমরা দেখেছি মানুষ যে কত সেক্রিফাইস করতে পারে। দেশকে যে কত ভালোবাসে। পাশাপাশি এটাও দেখেছি মানুষ কত খারাপ হতে পারে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কত ভয়ানক। আর রাজাকাররা যে কত সাংঘাতিক।

তাই দুটি জিনিস পাশাপাশি দেখে একই সঙ্গে মানুষের প্রতি আস্থা বেড়েছে। আর একই সঙ্গে মানুষ কত খারাপ হতে পারে তা দেখে বড় হয়েছি। সব কিছু মিলিয়ে আমি মনে করি, আমাদের যে প্রজন্ম তারা অনেক সৌভাগ্যবান এবং একই সঙ্গে খুব দুর্ভাগা। কাজেই তারা ভিন্নভাবে বড় হয়েছে। এটা শুধু আমিই না আমাদের প্রজন্মের সবাই একইভাবে বড় হয়েছে।

ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমাকে অনেক পছন্দ করে সেটা আমি টের পাই। তাই তাদের জন্য আমি লেখালিখি করি। তাদের কোনো কথা বললে তারা আমার কথা শুনে। স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমার কথা শুনে। তাই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমার এক ধরনের ভালোবাসার সম্পর্ক আছে।

প্রথমত, আমি মনে করি, আমাদের নতুন প্রজন্ম এক ধরনের দুর্ভাগা। কোনো একটা কারণে তাদের বাবা-মা মনে করেন পরীক্ষায় ভালো করা, পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো করা এটা জীবনের একটা উদ্দেশ্য। তবে এটা কিন্তু জীবনের উদ্দেশ্য না। জানা এবং শেখার সঙ্গে পরীক্ষার নম্বরের কোনো সম্পর্ক নেই।

তাই আমি মনে করি, পরীক্ষার নম্বরের কথা চিন্তা না করে কোনো একটা বিষয় সম্পর্কে তারা জানুক। ওদের কাছে আমার অনেক প্রত্যাশা আছে। কারণ আমাদের সময়টা আমরা কাটিয়েছি পাকিস্তানের পরাধীন একটা দেশে। কিন্তু ওরা তো পরাধীন দেশে জন্ম নেয়নি। তাদের একটা স্বাধীন দেশে জন্ম হয়েছে। তাই তাদের প্রতি প্রত্যাশাটা একটু বেশি।

তবে আমাদের একটা সৌভাগ্য বাংলাদেশটা কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি লাভ করছে। আমাদের যেভাবে কষ্ট করে বড় হতে হয়েছে সেটা কিন্তু তাদের করতে হচ্ছে না। তাই তাদের প্রতি দেশের আশাটা স্বাভাবিকভাবেই বেশি থাকবে।

পৃথিবীটা কিন্তু পরিবর্তনশীল। আস্তে আস্তে সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে। তুমি কি সার্টিফিকেট পেয়েছ; এটা কিন্তু তোমার থেকে কেউ জানতে চাইবে না। শুধু এটা জানতে চাইবে তুমি কী জানো। উদাহরণস্বরূপ একটা ছেলে প্রোগ্রামিংয়ে খুব ভালো।

কিন্তু কেউ জিজ্ঞেস করবে না যে তুমি প্রোগ্রামের কি জানো বা না জানো। শুধু এটুকুই বলব, তুমি কি কাজটা করতে পারবে। যদি পার তাহলে করে দাও। আর এই কাজের মাধ্যমে কিন্তু সে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে। কাজেই এই সৌভাগ্য এবং সুযোগ কিন্তু আমাদের সময় ছিল না। এটাতো এই প্রজন্মের সুযোগ। তাই আমরা আশা করব, তারা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে। এটা আমরা আশা করি তাদের প্রতি।

ভোরের আকাশ: বর্তমান প্রজন্মের উদ্দেশ্যে কী বলবেন?

জাফর ইকবাল: আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। তাই কেউ আর বই পড়ে না। তারা শুধু লাইক দেয়। কিন্তু পড়া বলে যে ব্যাপার আছে, তারা তো এটা ভুলেই গেছে। একটা ছোট বাচ্চা যখন আমার কাছে বই নিয়ে এসে অটোগ্রাফ নেয়। তখন আমি খুব খুশি হই। আমি পৃথিবীর মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করেছি।

যারা পড়ে, আর যারা পড়ে না। যারা পড়ে না তারা পৃথিবীকে কিছু দিতে পারবে না। আর যারা পড়ে পৃথিবী তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু পাবে। আমি চাই, বাচ্চারা অনেক বেশি বেশি পড়ুক। তাই আমি বাচ্চাদের বলতে চাই, ঘুমানোর আগে অন্তত দুটি পৃষ্ঠা হলেও পড়ে ঘুমাবা।

ভোরের আকাশ: হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে ফিরে যাই। আপনারা একসঙ্গে বড় হয়েছেন। তার সম্পর্কে একটি স্মৃতি জানতে চাই?

জাফর ইকবাল: তার জনপ্রিয়তা সম্পর্কে একটা ছোট গল্প করি। ‘আমি একদিন আমার বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ করে একজন আমার দিকে ছুটে এসে বলল, স্যার আপনি দেশে আসছেন শুনে আমি অনেক দূর থেকে হেঁটে হেঁটে আপনার কাছে আসছি দেখা করতে।

স্যার আমি কি আপনার হাতটা একটু ছুঁয়ে দেখতে পারি। তখন আমি তাকে বললাম হ্যাঁ দেখতে পারেন। তখন সে ধরে বলল, আহারে হুমায়ূন আহমেদের আপন ভাইয়ের হাত। সে আসলে আমার আছে আসেনি। সে হুমায়ূন আহমেদের ভাইয়ের কাছে এসেছে। এটাই মূলত হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তার লক্ষণ।

ভোরের আকাশ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

জাফর ইকবাল: ভোরের আকাশকেও অনেক ধন্যবাদ