ভালো নেই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ৩৬ বছর আগে প্রতিষ্ঠা পাওয়া এই রাজনৈতিক দলটি। আট বছরের বেশি সময় দলটি বিরোধী দলে থাকলেও সাংগঠনিক অবস্থা ভালো হয়নি এখনো। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ছয় ভাগে বিভক্ত হয়েছে জাতীয় পার্টি। অথচ কথায় সরব দলের কয়েকজন নেতা।
গত ১ জানুয়ারি ছিল জাপার ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সময়ও দলটি ছয় ভাগে বিভক্ত। অন্য পাঁচ ধারার অস্তিত্ব কার্যত বিলুপ্তির পথে। নামেমাত্র ‘মূলধারা’ হিসেবে পরিচিত এরশাদের ছোট ভাই জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন অংশটির অবস্থাও টালমাটাল।
জাপা সূত্রে জানা গেছে, মোট ৭৬টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে ৪২টিতে। ৩৪ জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। বিভিন্ন জেলার নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলাগুলোতে কমিটি থাকলেও তা একেবারেই নামেমাত্র। দলীয় ও জাতীয় কর্মসূচিও পালন হয় না এমন সাংগঠনিক জেলার সংখ্যা ৬০টির বেশি। এসব জেলায় দিনে দিনে নেতারা আরো বেশি রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়েছেন।
অনুসন্ধানে অন্তত ১৫ জেলা পাওয়া গেছে, যেখানে আহ্বায়ক কমিটি পর্যন্ত নেই। আবার এমন জেলাও রয়েছে ওই জেলায় ১৯৯০ সালে এরশাদ ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে কোনো কমিটি হয়নি। এই পরিস্থিতির মধ্যে নতুন করে জাপা গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা। ইতোমধ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচির ঘোষণা করেছেন বিদিশা।
নানামুখী চাপে দলের মূল ধারার অংশটিরও অবস্থা বেশ নাজুক। গেল ১৩ বছর ধরে মহাজোটের শরিক এরশাদের অংশটি। ১৯৯৬ সালেও আওয়ামী লীগকে আনুষ্ঠানিক সমর্থন দিয়েছিল এরশাদ। দলটির জন্মের পর থেকে স্বাধীন রাজনীতির মাঠ ছিল গত ১৩ বছর। অথচ এক যুগের বেশি সময় হাতে পেলেও রাজনৈতিকভাবে শক্তি অর্জন করতে পারেনি দলটি। বরং মূল শক্তি আরো কমেছে। বিভিন্ন জেলায় লাঙলের দুর্গে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে নৌকা।
কেন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? এ নিয়ে কথা হয়েছে জাপার ছয় ভাগের অন্তত ১০ জন শীর্ষ নেতার সঙ্গে।
তারা বলছেন, এরশাদের একক নেতৃত্বের কারণে জাপা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছে। জীবদ্দশায় কখনো সবাইকে এক করে পথ চলার উদ্যোগ নেননি সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ। যে কারণে মান অভিমান ভুলে সবপক্ষ একপক্ষ হয়ে পথ চলতে পারেনি।
তাহলে মূল ধারা কেন শক্তি হারাচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাবে জি এম কাদেরের সঙ্গে থাকা দলটির শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য হলো, দলকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। মিটছে না নানামুখী বিরোধও। বাইরে সরকারের বিরুদ্ধে কয়েকজন নেতা কথায় যত সরব, তত সরব নন সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে। ভেতরে ভেতরে সরকারের সঙ্গে লিয়াজোঁ করার কারণেই সংগঠনকে শক্তিশালী করা যাচ্ছে না। সবাই পার্টির নামে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত।
তারা বলছেন, গত ১৩ বছরে জাপার শক্তিশালী রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি নেই। তা ছাড়া তৃণমূলের প্রতিটি বৈঠকে নেতাদের দাবি একটাই সরকারের ঘর থেকে বের হয়ে নিজের মতো করে পথ চলা। জেলা-উপজেলা নেতাদের দাবি উপেক্ষিত হওয়ায় এদের অনেকেই ঘর ছাড়ছেন। ফলে তৃণমূলে শক্তি হারাচ্ছে দলটি।
এ ছাড়া জাপার অগ্রগতির পেছনে একটি বড় বাধা এরশাদের রেখে যাওয়া সম্পদ ও পারিবারিক কলহ। রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের পুরোনো বিরোধের সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছেন বিদিশা সিদ্দিক। বিদিশা সিদ্দিক নিজেই এখন জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। এরশাদের আত্মীয়দের একাংশ রয়েছেন জি এম কাদেরের সঙ্গে, বড় অংশটি বিদিশা ও রওশনকেন্দ্রিক। বিদিশাকেন্দ্রিক আত্মীয়দের লক্ষ্য এরশাদ ট্রাস্ট দখল করা। এসব কারণে পারিবারিক প্রাধান্য থেকে বেরোতে পারছে না দলটি।
অনেকে বলছেন, জাপার কর্মকাণ্ড এখন মূলত চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয় ও জি এম কাদেরকেন্দ্রিক। দলের কয়েক ডজন জ্যেষ্ঠ নেতাও নিষ্ক্রিয়। সংসদ সদস্যরা যতটুকু কাজ করেন, তা নিজেদের প্রয়োজনে। সংগঠন সম্প্রসারণের দিকে তাদের কোনো কর্মকাণ্ড নেই।
নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করার মতো কোনো কর্মসূচি নেই দলটিতে। যারা আছেন তাদের ধরে রাখার চেষ্টাও নেই। শুরুতে এরশাদের ক্ষমতার মোহে যে লোকগুলো জাপায় এসেছিলেন, এখন পর্যন্ত সেই বয়স্ক লোকেরাই জাপার মূল সম্পদ। নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব নেই বললেই চলে। এ ছাড়া দল পরিচালনায় রয়েছে অর্থসংকট। প্রয়াত এইচ এম এরশাদ দল পরিচালনা করার জন্য সর্বশেষ চার নেতার কাছে অর্থ গচ্ছিত রেখেছিলেন। একজনকে অর্থ দিয়েছিলেন চীনের সঙ্গে ব্যবসার জন্য, চীনের গুয়াংজুতে অফিসও নেওয়া হয়েছিল।
অপর একজনকে গুলশানে বিপণিবিতান নির্মাণ করার জন্য টাকা দিয়েছিলেন, প্রতিবেশী একটি দেশে বিপণিবিতানের জন্য অর্থ দিয়েছিলেন একজনকে, আরেক নেতার নামে কয়েক শ বিঘা জমি কেনা হয়েছিল সাভারে। এরশাদের মৃত্যুর পর নেতারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
৩৬ বছর আগে জনতা দল, কাজী জাফর আহমেদের ইউপিপি, গণতান্ত্রিক পার্টি ও মুসলিম লীগের একাংশের সমন্বয়ে গঠিত ‘জাতীয় ফ্রন্ট’ বিলুপ্ত করে ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি ‘জাতীয় পার্টি’ গঠন করেন সে সময়ের রাষ্ট্রপতি ও সাবেক সেনা প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। শুরু থেকেই পার্টির চেয়ারম্যান হন তিনি।
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এরশাদের জীবিতকালেই পাঁচ বার ভেঙেছে দলটি। ১৯৯১ সালে প্রথম জাতীয় পার্টি থেকে বেরিয়ে আলাদা জাতীয় পার্টি করেন এরশাদের আমলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম এ মতিন। ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে বেরিয়ে ‘জেপি’ নামে দল করেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। ২০০১ সালে জাতীয় পার্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিএনপি জোটে যোগ দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন নাজিউর রহমান মঞ্জু।
২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টি থেকে বের হয়ে পৃথক জাতীয় পার্টি গঠন করেন কাজী জাফর আহমেদ ও মোস্তফা জামাল হায়দার। এর আগে ২০০১ সালে কাজী জাফর আহমেদ ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন দল থেকে বেরিয়ে যান। কিছুদিন পর কাজী জাফর ফিরলেও শাহ মোয়াজ্জেম ফেরেননি। সর্বশেষ বিদিশার নেতৃত্বে জাপার আরেকটি অংশ তাদের মূল ধারা বলে ঘোষণা করেছে।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে এরশাদ কারাগারে থাকতে যে সফলতা পেয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে সে অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি জাতীয় পার্টি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জাপা ৩৫টি আসনে জিতেছিল। ১৯৯৬ সালে ৩২টি আসন। ২০০১ সালে পায় ১৪টি। ২০০৮ সালে পায় ২৭টি। ২০১৪ সালে পায় ৩৪টি, বর্তমান সংসদে জাপার আসন ২২টি। নির্বাচনী ফলাফলে দেখা যায়, দিনে দিনে দলটির অবস্থান দুর্বল হচ্ছে।
বর্তমান সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের শূন্য আসনের উপনির্বাচনে একমাত্র রংপুর-৩ আসনে সাদ এরশাদ বাদে অন্য সব আসনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জিতিয়ে দিতে দেনদরবারে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন জাপা প্রার্থীরা। একই অবস্থা হয়েছে সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও। ঢাকা-১৪ আসনে জাপার প্রার্থী প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় বিনা বাধায় জয়লাভ করেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী।
জাপার দুর্গ হিসেবে পরিচিত বৃহত্তর রংপুর। ইতোমধ্যে ওই এলাকার বেশির ভাগ সংসদীয় আসন জাপার বেহাত হয়েছে। সেখানে সংসদ থেকে স্থানীয় সরকারের বেশির ভাগ নির্বাচনে পাস করছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। এসব দিক বিবেচনায় দলটির মূল শক্তিই এখন হাতছাড়া।
জানতে চাইলে জাপা (জাফর) মহাসচিব আহসান হাবিব লিংকন বলেন, এরশাদ সাহেবের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার কারণে দিন দিন জাপা খণ্ডবিখণ্ড হয়েছে। তার মতে সবাইকে নিয়ে এক হয়ে নিজেদের মতো করে পথ চলার সুযোগ হলে আবারো জাপা মানুষের পছন্দের দলে পরিণত হতে পারে।
কেন শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলা যাচ্ছে না? এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, এটা সত্য যে, জাতীয় পার্টি যতটা গোছানো ও শক্তিশালী সংগঠন থাকার কথা ছিল, বাস্তবে তা নেই। এর কারণও রয়েছে।
পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জীবিত থাকাকালীন নানা ধরনের মামলা ঝুলিয়ে রেখে কার্যত তাকে এক ধরনের বন্দিদশাতেই রাখা হয়েছিল। তাকে সংগঠন গোছানোর সুযোগ দেওয়া হয়নি। এরপর আমাদেরও কিছু ব্যর্থতা রয়েছে, যেভাবে পারার কথা ছিল আমরা পারিনি। তবে বলতে পারি, আগামী দিনগুলোতে এ দশা থাকবে না। আমরা দেশব্যাপী সাংগঠনিক কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।
মূলধারার জাপাকে কেন শক্তিশালী করা যাচ্ছে না? জানতে চাওয়া হয় দলে বারবার মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করা এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের কাছে। তিনি বলেন, কারো একার পক্ষে দলকে শক্তিশালী করা সম্ভব নয়। এজন্য কেন্দ্র থেকে কর্মসূচি থাকতে হয়। দলে আন্তরিকতা থাকতে হয়। সেদিক থেকে আমরা সব সময় পিছিয়ে ছিলাম। তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ কোন্দল এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা।
জাপা চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মনিরুল ইসলাম মিলন বলেন, অনেকের ইচ্ছা আছে জাপাকে মানুষের ভালোবাসার দলে রূপ দেওয়ার। কিন্তু এককভাবে এই দায়িত্ব কারো পক্ষে পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি মনে করেন, এখনো উদ্যোগ নেওয়া হলে দলছুট নেতাকর্মীদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব।