logo
আপডেট : ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১১:৩৪
পিলখানা হত্যাযজ্ঞের ১৩ বছর
হত্যা মামলার বিচার চূড়ান্ত পর্যায়ে
এম বদি-উজ-জামান

পিলখানা হত্যাযজ্ঞের ১৩ বছর

পিলখানায় সংঘটিত জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞে নিহতদের স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন। ছবি- সংগৃহীত

বহুল আলোচিত পিলখানায় সংঘটিত জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের ১৩ বছর অতিবাহিত হলেও হত্যা মামলার বিচার চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হয়নি। এ মামলায় এখন পর্যন্ত হাইকোর্টে বিচার সম্পন্ন হয়েছে।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা আপিল করলেও যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা এবং রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ পাবেন কি না তা নির্ভর করছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের ওপর। আর এ পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের করা আপিল এবং বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের করা লিভ টু আপিল আবেদনের ওপর কবে শুনানি হবে তারও সিদ্ধান্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের হাতে।

এমনকি ওই ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলার বিচার সম্পন্ন হতে কত বছর লাগবে তা জানা নেই কারো। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় ১২৬৪ জন সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ২১০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের এবং রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করার অনুমতি চেয়ে (লিভ টু আপিল) করা আবেদনের ওপর শুনানিতে আসামিপক্ষ বা রাষ্ট্রপক্ষের কারো উদ্যোগ নেই। এ নিয়ে পরস্পরকে দোষারোপ করছেন উভয়পক্ষ।

রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমীনউদ্দিন বলছেন, আসামিপক্ষ আবেদন করে বসে আছে। তারাই তো শুনানি করছে না। ফলে শুনানিতে বিলম্ব হচ্ছে। আর আসামিপক্ষে আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম বলছেন, রাষ্ট্রপক্ষই শুনানিতে আগ্রহী নয়। রাষ্ট্রপক্ষ প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করলেইতো শুনানি হয়।

তিনি বলেন, সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে যাদের সাজা খাটা হয়ে গেছে এবং যাদের খালাসের রায় দেওয়া হয়েছে তাদের কেউই মুক্তি পাচ্ছেন না। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলার আসামি হওয়ায় ওই মামলার বিচার সম্পন্ন না হওয়ায় তারা এখনো কারাবন্দি। এটা অমানবিক।

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআরের (বাংলাদেশ রাইফেলস) বর্তমান বিজিবি সদর দপ্তর পিলখানায় বিডিআরের সদস্যদের হাতে দেশের মেধাবী সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে প্রাণ দিতে হয়। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর দায়ের করা দুটি মামলার মধ্যে হত্যা মামলাটির বিচার এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। এরই মধ্যে হত্যা মামলায় নিম্ন আদালত ও হাইকোর্টে রায় প্রদান করা হয়েছে।

এ মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা আপিল এবং যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ও অন্যান্য মেয়াদে সাজাপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে আপিল করার অনুমতি চেয়ে (লিভ টু আপিল) আবেদন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাজা বাড়াতে ২০টি আবেদন করা হয়েছে।

এদিকে একই ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে অভিন্ন আসামিদের বিরুদ্ধে করা মামলায় নিম্ন আদালতে এখনো বিচার সম্পন্ন হয়নি। এই মামলায় ২০১০ সালে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হলেও গত ১২ বছরে ১২৬৪ জন সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ২১০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। ফলে এ মামলাটিতে নিম্ন আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব শেষ হয়ে রায় প্রদানে আরো কয়েক বছর লেগে যেতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস সদর দপ্তরে সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন হত্যার ঘটনায় ওই বছরের ৪ মার্চ লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নবজ্যোতি খীসা বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। পরে মামলাটি ৭ এপ্রিল নিউ মার্কেট থানায় স্থানান্তর হয়।

ডিএডি তৌহিদসহ ছয়জনের নাম উল্লেখ করে করা মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি দেখানো হয় প্রায় এক হাজার জওয়ানকে। তদন্ত শেষে সিআইডি ২০১০ সালের ১২ জুলাই হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়। এর মধ্যে হত্যা মামলায় বিচার শেষে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত এ মামলায় রায় দেয়।

এরপর নিম্ন আদালত থেকে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের আবেদন) পাঠানো হয়। এছাড়া কারাবন্দি সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা আপিল করে। রাষ্ট্রপক্ষও আপিল করে।

উভয় আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর প্রকাশ্য আদালতে সংক্ষিপ্ত রায় দেন। ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ে ১৩৯ জনকে ফাঁসি, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ২শ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এছাড়া নিম্ন আদালতের সাজা বিরুদ্ধে ২৮ জন আপিল না করায় তাদের সাজা বহাল রাখা হয়। সবমিলে ৫শ ৫২ জনকে সাজা দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের রায়ে ২৮৩ জনকে খালাস দেওয়া হয়।

জানা গেছে, হাইকোর্ট যাদের খালাস দিয়েছেন এদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে। এছাড়াও সাজা কম দেওয়া হয়েছে এমন কয়েকজনের বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাজা বাড়াতে আবেদন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এ রকম ২০টি আবেদন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। আর সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে ২০৩ জনের পক্ষে ৪৯টি আবেদন দাখিল করা হয়েছে। কয়েকজন আসামিরপক্ষে কারাগার থেকে ২টি আবেদন (জেল আপিল) করা হয়েছে।

নিয়ম অনুযায়ী, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে এই আপিলের বিচারের মধ্য দিয়ে মামলাটির বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হবে। যদিও এরপর রিভিউ আবেদন করার সুযোগ থাকবে।

রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করা ছাড়া আর কোনো সুযোগ থাকবে না। এই নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের কারণে সরকার বাহিনীর নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) নামকরণ করেছে।

বহুল আলোচিত পিলখানা হত্যা মামলায় বিচার শেষে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত রায় দেয়। রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আর ২৭৮ জনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।

এরপর ফাঁসির আসামিদের সাজা অনুমোদনের জন্য নিম্ন আদালত থেকে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হয়। কারাবন্দি আসামিরা সাজার বিরুদ্ধে আপিল করেন। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকেও পৃথক তিনটি আপিল করা হয়। সব আবেদনের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্ট রায় দেন।