logo
আপডেট : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১০:৪৪
বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল দুই দশকেই বিলীন 
উদ্ধারে অগ্রগতি নেই
শাহীন রহমান

বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল দুই দশকেই বিলীন 

পরিবেশবাদীরা বলছেন, এখান দিয়ে এক সময় লঞ্চ, স্টিমার, বড় বড় ইঞ্জিন বোর্ডসহ বিভিন্ন নৌযান চলাচল করত। ছবি- ভোরের আকাশ

মাত্র দুই দশক আগে ঢাকার কামরাঙ্গীরচর হয়ে হাজারিবাগ ও রায়েরবাগ হয়ে বয়ে চলত একটি নদী। অনেকে একে বুড়িগঙ্গার শাখা হিসেবে চিনতেন। শাখা নদী বলা হলেও মূলত এটি বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল হিসেবে পরিচিত।

তবে পরিবেশবাদীরা বলছেন এটিই আসল বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গার প্রধান প্রবাহ এক সময় এ শাখা নদী দিয়েই ছিল। দেশের প্রথম ভূমি জরিপে এটিকে প্রবহমান নদী হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। এখান দিয়ে এক সময় লঞ্চ, স্টিমার, বড় বড় ইঞ্জিন বোর্ডসহ বিভিন্ন নৌযান চলাচল করত। দুই যুগের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় এটি দখল হয়ে যায়। বর্তমানে এ শাখা নদী প্রায় বিলুপ্তির পথে।

ঢাকার কামরাঙ্গীরচর থেকে রায়েরবাগ পর্যন্ত সাত কিলোমিটারকে বলা হয় আদি বুড়িগঙ্গা। সম্প্রতি এই আদি চ্যানেল উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নদী উদ্ধারে আদালত রায়ও দিয়েছেন। সেই অনুযায়ী বিআইডব্লিউটিএ থেকে মাঝে মাঝে দখল অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

এটি উদ্ধার করা গেলে আদি বুড়িগঙ্গার তীরে দৃষ্টিনন্দন পার্ক, বাগান ও হাঁটার পথ এবং বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়েছে। তবে পুরোপুরি দখলমুক্ত করে এই পরিকল্পনা কতটা সফল হবে তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও পরিবেশ সংগঠন পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুস সোবহান বলেন, বেপরোয়া দখল ও ভরাটে ক্রমবর্ধমান ও অব্যাহত আগ্রাসনের ফলে বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল এখন প্রায় মৃত। মহানগরী ঢাকার জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাইকোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও ঢাকার প্রাণস্বরূপ বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্ন কিছু উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়েছে মাত্র। যা কোনো কাজে আসেনি।

ফলে ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলের বুড়িগঙ্গা আদি চ্যানেলসংলগ্ন মোহম্মদপুর, রায়েরবাজার, হাজারিবাগ, কালুনগর, ভাগলপুর, নবাবগঞ্জ, শহীদনগর, কামালডাঙ্গা, ইসলামবাগসহ এ এলাকার খালগুলোও এখন মরতে বসেছে। এসব এলাকায় বর্ষার সময় সামান্য বৃষ্টিতেই ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। অধিক বৃষ্টিতে অনেক ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যায়।

তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গা আদি চ্যানেল দখল ভরাট করে নির্মাণকৃত কারখানা ও বাড়িঘরের পানি বিদ্যুৎ গ্যাসসহ সব নাগরিক সুযোগ এখনই বন্ধ করে দিতে হবে। সব ধরনের দখল ও ভরাট এবং দূষণমুক্ত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। এজন্য আগে সিএস রেকড অনুযায়ী বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলের সীমানা নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী সীমানা পিলার স্থাপন করতে হবে।

বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল উদ্ধারের জন্য ২০২০ সালের মার্চ মাসে হাইকোর্ট একটি নির্দেশনা দেয়। আদালতের রায়ে আদি বুড়িগঙ্গাসহ বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের নির্দেশ দেয়। তবে এই রায়ের পর একাধিকবার অবৈধ দখলদার উচ্ছে অভিযান চালায় বিআইডব্লিউটিএ। এখন পর্যন্ত কিছু দখলদার উচ্ছেদ করা গেলেও অনেকে রয়েছে গেছে। আবার রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পুনরায় দখলদার ফিরে আসছে।

সর্বশেষ গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে ৬ দিনের দখল উচ্ছেদ পরিচালনা করেছে বিআইডব্লিউটিএ। এই সময়ে তারা আদি বুড়িগঙ্গার দখল হয়ে যাওয়া পাঁচ একর জমি উদ্ধার করেছে। উচ্ছেদ করা হয়েছে ৩ শতাধিক অবৈধ স্থাপনা। তবে বারবারই দখলদাররা আবার ফিরে আসছে।

বুড়িগঙ্গার এই আদি চ্যানেল রক্ষা এবং উন্নয়নমূলক কার্যপরিচালনার জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এতে নদীর তীর রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াও ছোট ছোট পার্ক, বসার জায়গাসহ আরো অনেক কিছুর পরিকল্পনা আছে রয়েছে। প্রকল্প পরিচালক খায়রুল বাকের জানিয়েছেন পরামর্শক নিয়োগ করে এসব পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হবে।

তবে নদী-সংশ্লিষ্টরা বলছেন বুড়িগঙ্গার আদি চ্যালেন এখন পুরোটাই দখল হয়ে গেছে। বড় স্থাপনার পাশাপাশি সরকারি স্থাপনাও হয়েছে সেখানে। এমন অভিযোগ রয়েছে যারা দখল করেছেন তারা ভূমি অফিস থেকে কাগজপত্র তৈরি করে বিক্রিও করে দিয়েছেন। সরকার খাজনা নিচ্ছে। বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল দখলে একটি চক্র কাজ করেছে। এই চক্রে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের লোকজনও আছেন। ফলে উচ্ছেদের পর আবার দখল হয়ে যাচ্ছে।

এমনকি এর আগে উদ্ধার করা নদীর জমি পানি উন্নয়ন বোর্ড লিজ দিয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। এমন অবস্থায় বুড়িগঙ্গার আদি চ্যালেন উদ্ধারের কতটা সফল হওয়া যাবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন শুরু থেকেই পদক্ষেপ নিলে বুড়িগঙ্গার এই আদি চ্যানেলটির মৃত্যু হতো না। কিন্তু পশ্চিমের এই শাখা নদীটি রক্ষার চেষ্টা করা হয়নি কখনো। নদীর অন্যান্য অংশে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে বারবার অভিযান চালানো হলেও এ অংশের দখলদাদের স্পর্শও করা হয়নি। ফলে বিনা বাধায় বুড়িগঙ্গার আদি চ্যালেনটি দখল হয়ে গেছে।

জানা গেছে, আদি চ্যানেল হিসেবে পরিচিত বুড়িগঙ্গার এই অংশটি বন্দর সীমার অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় প্রথমদিকে দখল দূষণের কোনো হিসাব রাখেনি বিআইডব্লিটিএ। এ সুযোগে প্রায় সম্পূর্ণ দখলে চলে গেছে। চোখের সামন্যেই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে নদীটি। প্রায় দুই দশক আগে নদীর দখলদারত্ব শুরু হয়। বর্তমানে নদীটি প্রায় নিঃশেষ অবস্থায় পতিত হয়েছে।

তবে আদি চ্যানেলে কামরাঙ্গীচর অংশে এখনো নদী হিসেবে কিছু চিহ্ন রয়েছে। তাও হাজারো দখলদার এর ওপর থাবা বসিয়েছে। এর পর থেকেই নদীর আর কোনো চিহ্ন নেই। নদী দখল করে বসতি স্থাপন হয়েছে লাখ লাখ লোকের। এছাড়াও বছিলার কাছে কিছু অংশ ক্যানালের মতো সরু হয়ে বুড়িগঙ্গা মিশেছে। নদীর অন্যান্য অংশে সামীনা চিহ্নিত করে পিলার বসানো হলেও আদি চ্যানেলে আজ পর্যন্ত কোনো সীমানা চিহ্নিত করা হয়নি। উদ্যোগ নেওয়া হয়নি পিলার বসানোর।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেপরোয়া ভরাট, দখল ও দূষণের ফলে ঢাকার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে চ্যানেলটি। জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশ রক্ষায় বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল পুনরুদ্ধার করা জরুরি বলে মনে করছেন তারা।