logo
আপডেট : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৬:১১
ভোরের আকাশকে কামরুল হাসান
যেভাবেই হোক দেশে ফিরতে হবে
তরিকুল ইসলাম

যেভাবেই হোক দেশে ফিরতে হবে

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা। ছবি-ভয়েস অব আমেরিকা

গাজীপুর থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য ২০১৪ সালে ইউক্রেনে পাড়ি জমিয়েছিলেন কামরুল হাসান। আইটি-বিষয়ক পড়াশোনা শেষ করে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করছিলেন। বেশ ভালোই ছিলেন তিনি। দেশটিতে রুশ সেনাদের প্রবেশ ও হামলার বিষয়ে অনলাইনে ভোরের আকাশের সঙ্গে কথা হয় তার।

গত বুধবার থেকে শুক্রবার ইউক্রেন-পোল্যান্ড সীমান্তের লিভিভ অঞ্চলের বুদোমেজ হ্রুশিভ চেক পয়েন্টে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তিনি বলছিলেন, ‘রুশ বাহিনীর ইউক্রেন সীমান্ত প্রবেশের পরপরই সিদ্ধান্ত নিই, এখানে থাকাটা আর নিরাপদ নয়। এখানে আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে, সেটি আপনি অন্য কোথাও বসে অনুধাবন করতে পারবেন না।’

কামরুল হাসান বলেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী যে ইতিহাস আমরা শুনেছি। আমার কাছেও এখানকার পরিস্থিতিটা সেরকমই মনে হচ্ছে। প্রকৃত অবস্থা কী, সেটা কারোর পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। এমনকি এখানে যারা আছেন তারাও না। বোমা বিস্ফোরণের মতো যে আওয়াজগুলো পেয়েছি সেটা আমার পরিচিত নয়। কয়েক দফার এই শব্দকে কেউ কেউ বোমা বিস্ফোরণ বললেও আমার কাছে মনে হয়েছে ভিন্ন কিছু। ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে।

‘আপনারা দেখেছেন রুশ সেনারা কীভাবে একটি ব্যক্তিগত সাধারণ কারকে পিষে দিয়েছে, এই ভিডিও দেখেই আমি আরো বেশি শঙ্কিত হয়ে যাই। অবশেষে আমাকে দেশে ফিরতে হচ্ছে এবং আমার সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে এটা আমি আর ভাবতেই পারছি না। আমি এখন পোল্যান্ড সীমান্তের দিকে যাচ্ছি, যেভাবেই হোক দেশে ফিরতে হবে।

পোল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের একটি টিম ইউক্রেইন-পোল্যান্ড সীমান্তের লিভিভ অঞ্চলের সীমান্ত এলাকায় বুদোমেজ হ্রুশিভ চেকপয়েন্টে বাংলাদেশিদের প্রবেশে সহযোগিতা করছে। ওই চেকপয়েন্ট ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে। বাংলাদেশিদের দ্রুত সেবা নিশ্চিত করতে ইতালি ও জার্মানিতে বাংলাদেশ দূতবাস কর্মীরাও পোল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছেন।

পোল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হোসেন শনিবার ভোরের আকাশকে বলেন, ইউক্রেন থেকে গত দুই দিনে (শুক্র ও শনিবার) কয়েক দফায় এখন পর্যন্ত ২৪ বাংলাদেশি সীমান্ত পার হতে পেরেছেন। আরো অনেকে আসার জন্য অপেক্ষা করছেন এবং তাদের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। যারা পোল্যান্ড সীমান্ত পার হতে পেরেছেন, আমরা তাদের দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছি। পরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশেষ করে যারা সীমন্ত পার হবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাদের অবশ্যই নিজ নিরাপত্তার বিষয়গুলোতে সজাগ থাকতে হবে। এমনকি দু-এক দিনের খাবারও সঙ্গে রাখতে হবে।

সীমান্তে মোবাইল নেটওয়ার্কের সমস্যার কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, অনেক সময় আমরা আমাদের দূতাবাসের টিমের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারি না। এজন্য সুবিধাজনক জায়গায় গিয়ে তাদের কথা বলতে হয়। এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এটা একটি বাড়তি জটিলতা।

দূতাবাসের ফেসবুক পেজে জসিম উদ্দিন নামে অপর এক বাংলাদেশির কমেন্ট ‘পোল্যান্ডে আমাদের রাষ্ট্রদূত মহোদয়ের প্রতি আমার একটা পরামর্শ- প্রবাসী বাংলাদেশি যাদের পাসপোর্ট নেই, তাদের ক্ষেত্রে আরেকটু সহজ একটা ব্যবস্থা করুন, তা হলো- কালার ফটো পোল্যান্ড বর্ডারে এসে তোলার ব্যবস্থা করুন। কারণ- যুদ্ধের সময় হয়তো ছবি তুলতে অনেক অসুবিধা এবং রিস্ক আছে।’
পোল্যান্ড সীমান্ত ছাড়াও রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া ও মলদোভা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশিরা যাতে ইউক্রেন ছাড়তে পারেন সেজন্য এই দেশগুলোতে বাংলাদেশ মিশনগুলোও প্রস্তুতি নিচ্ছে। চালু করা হয়েছে হটলাইন।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেছেন, ‘সীমান্ত অতিক্রম করা বাংলাদেশি নাগরিকরা সাময়িকভাবে পোল্যান্ডে থাকবেন। ইউক্রেনে আটকা পড়াদের পোল্যান্ড সরকার ১৫ দিনের ভিসা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আমরা আশা করি, এই সময়ের মধ্যেই আমরা তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে পারব এবং অন্য কোথাও নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করব।
পোল্যান্ড থেকে বিশেষ ফ্লাইটের জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও আমাদের কথা হয়েছে।’

‘এরই মধ্যে পোল্যান্ডে আমাদের রাষ্ট্রদূত একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলেছেন। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটিতে এখন পর্যন্ত ২৫০ জন আছেন, তারা বলেছেন আরো বাংলাদেশি সেখানে রয়েছেন। আমরাও ধারণা করছি, সেখানে ৫০০-এর মতো বাংলাদেশি হয়তো রয়েছেন। গ্রুপে আমাদের রাষ্ট্রদূত তাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন এবং পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।’

সাম্প্রতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের অবিলম্বে ইউক্রেন ত্যাগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সকল বাংলাদেশীকে অত্যাবশ্যকীয় না হলে ইউক্রেনে সকল প্রকার ভ্রমণ পরিহার করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়।

পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ভোরের আকাশকে বলেন, ‘কোনো ধরনের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি ও সংঘাতের সৃষ্টি হয় এমন কিছুকে সমর্থন করে না বাংলাদেশ। ইউক্রেন ইস্যুতে আমরা কারো পক্ষে-বিপক্ষে যেতে পারি না। কারণ সব দেশই আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র। নীতিগতভাবেই এটি আমাদের অবস্থান। আশা করি কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দুই পক্ষ আলোচনা করে শান্তিপূর্ণ একটি সমাধানে পৌঁছাবে।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইউক্রেনে অবস্থানকারী বাংলাদেশীদের বাংলাদেশ দূতাবাসের নিম্নোক্ত নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করেছে: পোল্যাান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মকর্তা অনির্বাণ নিয়োগীর +৪৮৫৭২০৯৪৩৮১ নম্বর।

স্লোভাকিয়া এবং হাঙ্গেরির জন্য: অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় বাংলাদেশ দূতাবাস: (১) রাহাত বিন জামান, ডেপুটি চিফ অব মিশন: +৪৩ ৬৮৮ ৬০৩৪৪৪৯২, (২) জুবায়াদুল এইচ. চৌধুরী, এসিও: +৪৩ ৬৮৮ ৬০৬০৩০৬৮। রোমানিয়া এবং মলদোভার জন্য: রোমানিয়ার বুখারেস্টে বাংলাদেশ দূতাবাস: (১) +৪০ (৭৪২) ৫৫৩ ৮০৯, (২) মীর মেহেদী হাসান (টেলি এবং হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ) +৪০ (৭৪২) ৫৫৩ ৮০৯, পোল্যান্ডের জন্য: পোল্যান্ডের ওয়ারশতে বাংলাদেশ দূতাবাস: (১) মো. মাসুদুর রহমান +৪৮ ৭৩৯ ৫২৭ ৭২২, (২) মো. মাহবুবুর রহমান +৪৮ ৫৭৯ ২৬২ ৪০৩, (৩) ফারহানা ইয়াসমিন +৪৮ ৬৯০ ২৮২ ৫৬১, (৪) বিল্লাল হোসেন +৪৮ ৭৩৯ ৬৩৪ ১২৫ ও (৫) মো. রাব্বানী +৪৮ ৬৯৬ ৭৪৫ ৯০৩ ।

এদিকে সংলাপের মাধ্যমে ইউক্রেন সংকট সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে ইউক্রেনে সাম্প্রতিক সহিংসতা বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে এ আহবান জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, ইউক্রেনের এই ধরনের সহিংসতা সমগ্র অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। তাই আমরা সব পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম, শত্রুতা বন্ধ ও কূটনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে এই সংকট সমাধানের আহ্বান জানাই।

আমরা ইউক্রেনে থাকা বাংলাদেশিদের নিরাপদ স্থানে এবং প্রয়োজনে পোল্যান্ডে যেতে বলেছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পোল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে নিবিড় সমন্বয় বজায় রেখেছে। আমরা সেখানে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের দেশে অবিলম্বে প্রত্যাবাসনের জন্য সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। সমস্ত কনস্যুলার সহায়তা বিনামূল্যে দেওয়া হবে।