ময়মনসিংহ জেলায় প্রায়ই কঙ্কাল চুরির ঘটনা ঘটছে। জেলায় ২০২০ সালে ২১টি ও ২০২১ সালে ৫টি কঙ্কাল চুরি হয়েছে। মূলত বিগত কয়েক বছর ধরেই এ কঙ্কাল চুরির ঘটনা ঘটছে। এ নিয়ে আতঙ্কে রয়েছে জেলাবাসী। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে? কেন এ কঙ্কাল চুরি করা হয়? কারাই-বা এর ক্রেতা?
অনেকেরই ধারণা চুরি যাওয়া এসব কঙ্কাল মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্যই নিয়ে যাওয়া হয় এবং এক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেন হয়। তবে মর্গে বেওয়ারিশ লাশ থাকার কারণে কবর থেকে চুরি করা কঙ্কাল মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে পুলিশের একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, যেহেতু মেডিকেল কলেজে কঙ্কালের চাহিদা রয়েছে, সেহেতু ‘ব্ল্যাক মার্কেটে’ একটি চক্র কঙ্কাল অথবা কবর থেকে লাশ চুরির কাজটি করতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, ‘একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী প্রথম বর্ষে ভর্তি হলেই তাকে কঙ্কাল কিনতে হয়। একটি কঙ্কালের দাম পড়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। সরকারি কিংবা বেসরকারি সকল মেডিকেল শিক্ষার্থীর কঙ্কাল প্রয়োজন হয়, যা কয়েকটি বেওয়ারিশ লাশের কঙ্কাল দিয়ে গবেষণা করা কঠিন।
‘এ কারণে বেশিরভাগ মেডিকেল কলেজে এক থেকে দুই শিক্ষার্থী (তৃতীয় বর্ষ) কঙ্কালের ব্যবসা করেন। তাদের কাছ থেকেই প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা কঙ্কাল কিনে নেন। দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত গবেষণার পর তৃতীয় বর্ষে উঠলে এ কঙ্কালগুলো ফের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছে একই দামে বিক্রি করে দেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘একটি কঙ্কালের ২০৬টি হাড় থাকতে হবে। এর কম হলেই দাম কমে যাবে। এ কঙ্কালগুলো নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে শিক্ষার্থীরা (তৃতীয় বর্ষ) যেকোনো মাধ্যমে সংগ্রহ করেন। এরপর প্রত্যেকটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে বিক্রি করা হয়। তবে মাঝে মধ্যে একটি কঙ্কাল দুই থেকে তিনজন মিলে কিনে নেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যে কঙ্কালগুলো কিনে নিয়ে গবেষণা করছে, সবগুলো কঙ্কাল বেওয়ারিশ লাশের না। কারণ এত বেশি বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া যায় না।’
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডা. চিত্তরঞ্জন দেবনাথ বলেন, ‘হাসপাতালের যেসব লাশ কেউ নেয় না, অর্থাৎ বেওয়ারিশ হিসেবে পড়ে থাকে, সেই লাশগুলোকে আমরা আমাদের ডিপার্টমেন্টে নিয়ে আসি। এরপর শিক্ষার্থীরা শেখার জন্য লাশগুলোকে কাটাছেঁড়া করে দেখে শরীরের ভেতরে কী কী আছে।’
তিনি বলেন, ‘মানবদেহের একেকটি হাড় মাংসের সঙ্গে খুব শক্ত করে জড়ানো থাকে। ফলে হাড় থেকে মাংস ছাড়ানোর জন্য বেওয়ারিশ লাশটিকে বিভিন্ন কেমিক্যালের মাধ্যমে প্রসেসিং করা হয়। এভাবে হাড় থেকে মাংস আলাদা করে শিক্ষার্থীরা।’
কবর থেকে চুরি যাওয়া কঙ্কালগুলো দিয়ে শিক্ষার্থীরা গবেষণা করে কিনা? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমাদের এখানে যথেষ্ট বেওয়ারিশ লাশ আছে, তাই চুরি করা কঙ্কাল আমাদের কাছে আসার প্রয়োজন নেই। তবে চোর চক্রটি হয়তো লাশ প্রসেসের মাধ্যমে কঙ্কাল তৈরি করে বিক্রিও করতে পারে। কিন্তু তারা কী উদ্দেশ্যে চুরি করে কিংবা কাদের কাছে বিক্রি করে সেটা তারাই জানে।’
এদিকে পুলিশের অভিযানে এ পর্যন্ত জেলায় কঙ্কাল চুরি চক্রের সদস্য বাপ্পিকে (২৫) গ্রেপ্তার করা হলেও অনেকেই থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ২০২০ সালে ১২টি মাথার খুলি ও দুই বস্তা মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের হাড় উদ্ধার করে পুলিশ। একইসঙ্গে দুই কনটেইনার তরল ক্যামিকেল ও তিন প্যাকেট গুঁড়া কেমিক্যালও উদ্ধার করা হয়।
প্রতিটি পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল ২০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা দামে পাশের হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করেছিলেন বাপ্পি। ওই চোর চক্রের সদস্যরা সামান্য টাকায় কবর থেকে লাশ চুরি করে নিয়ে কেমিক্যাল বা দ্রুত পচনে সাহায্যকারী পদার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত সম্পন্ন করে কঙ্কাল পাচারকারীর হাতে তুলে দেয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।
বাপ্পি ময়মনসিংহ নগরীর কালিবাড়ী কবরস্থান এলাকার আবুল হোসেনের ছেলে।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ সুপার মোহা. আহমার উজ্জামান বলেন, ‘কঙ্কালসহ বাপ্পি নামে একজনকে গ্রেপ্তারের পর আমরা তার কাছ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছিলাম। সেই সূত্র ধরেই আমরা কাজ করছি। এগুলো যারা করছে তাদের খোঁজা হচ্ছে।’
ময়মনসিংহ র্যাব-১৪ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কবর থেকে লাশ কিংবা কঙ্কাল চুরির কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। তবে আমরা এ চোর চক্রটিকে ধরতে অনুসন্ধান চালাচ্ছি।’