মানুষ ও ভোটারদের নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফেরানোই নতুন ইসির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, বিগত দুটি কমিশন দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা অনেকটা বিতর্ক করে ফেলেছে। ভোট নিয়ে জনগণ ও ভোটারদের আগ্রহ কমেছে অনেক। এজন্য আগে রাজনৈতিক দলগুলোকে যেমন আস্থায় নিতে হবে। পাশাপাশি জনগণকে অধিকমাত্রা সম্পৃক্ত করতে হবে এ ব্যবস্থার প্রতি। দায়িত্ব নিয়ে তাদের এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাই প্রধান কাজ বলেও উল্লেখ করেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় এখনো এক হতে পারেনি দলগুলো। বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত বিএনপি বরাবরই এতে অনাগ্রহ দেখিয়ে আসছে। সংলাপ বর্জনের পাশাপশি রাষ্ট্রপতি গঠিত সার্চ কমিটিতে তারা ইসিতে নিয়োগের জন্য কারো নামের প্রস্তাব দেয়নি। শুধু বিএনপি নয়, ইসির নিবন্ধিত মোট ১৩টি দল সংলাপ এবং ইসি গঠন নিয়ে কোনো ধরনের আগ্রহ দেখায়নি। দলগুলো বরাবরই অভিযোগ করে আসছে এ সরকারের অধীনে গঠিত নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ধরনের ভূমিকা নিতে পারবে না। আজ্ঞাবহ হিসেবেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। ফলে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
বিএনপি আরো একধাপ এগিয়ে বলছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে ইসি গঠন করেই নির্বাচন দিতে হবে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করে বলেন, নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপি কোনো মাথাব্যথা নেই। মাথাব্যথা নির্বাচনকালীন সরকারে কারা থাকবে। আমাদের একটাই দাবিÑ একটাই তা হলো, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান।
গত শনিবার সাবেক প্রতিরক্ষা সচিব কাজী হাবিবুল আউয়ালকে প্রধান করে দেশের ১৩তম নির্বাচন কমিশন গঠন করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। নতুন নিয়োগ পাওয়া ইসি আজ সোমবার তাদের দায়িত্ব বুঝে নেবে। এর আগে রোববার বিকালে শপথ নেন তারা।
ইসিতে নিয়োগ পাওয়ার পরই প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়াল এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, নির্বাচনে সব দলের প্রতি সমান আচরণ করতে তিনি কাজ করবেন। দায়িত্ব পালনে যদি রাজনৈতিক দলে সহযোগিতা পাওয়া না যায়, তাহলে ইমেজ সংকট হতে পারেও বলেও মন্তব্য করেন। তবে কোনো কিছু চ্যালেঞ্জ বলে পিছুপা হওয়ার সুযোগ নেই। এটি মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাব উল্লেখ করেন।
কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে ইসিতে নতুন নিয়োগ পাওয়া অন্য কমিশনারদের মধ্যে রয়েছেন অবসরপ্রাপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশিদা সুলতানা, ব্রিগেডিয়ার জেলারেল (অব.) আহসান হাবিব খান, সাবেক সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর এবং সাবেক সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান। এ ইসির অধীনেই আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এ ইসির হাতে দুই বছরেরও কম সময় হাতে রয়েছে। এর আগে তাদের বেশ কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন পরিচালনা করতে হবে। বিশেষ করে খুলনা রাজশাহী, বরিশাল সিলেট ও গাজীপুর, রংপুর এবং কমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন পরিচালনা করতে হবে জাতীয় নির্বাচনের আগেই।
পক্ষপাতের অভিযোগে দীর্ঘদিন ধরে দেশের বড় একটি রাজনৈতিক দল বিএনপি স্থানীয় এসব নির্বাচন বর্জন করে আসছে। ফলে নির্বাচন অনেকটা একপাক্ষিক হয়ে পড়ছে। সহিংসতা বাড়েছে অনেকগুণ।
বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ জনগণের মধ্যেও দুটি নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অব. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশনের পাহাড় সমান চ্যালেঞ্জ আছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ জনগণ ও ভোটারদের নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা। কমিশনের সততা ও আন্তরিকতার বিষয়ে জনগণ ও রাজনৈতিক দলকে আশ্বস্ত করতে হবে।
জনগণের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকেও প্রথমে আস্থায় নিতে হবে। দুই বছরের কম সময়ের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রায় ১৭ লাখ জনবল এবং কয়েক হাজার উপকরণের প্রয়োজন। এছাড়া তাদের প্রশিক্ষণের, আইনের পর্যালোচনা, প্রয়োজনে সংশোধন যেমন রয়েছে। রাজনৈতিক বিভাজন কমানোর প্রচেষ্টা এবং সব দলকে নির্বাচনে আনার প্রচেষ্টা হবে বৃহত্তর চ্যালেঞ্জ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একতরফা নির্বাচন এবং বিনাভোটে প্রার্থীদের নির্বাচিত হওয়ার কারণে আগের দুটি কমিশন অনেকটাই বিতর্কিত হয়ে পড়ে। কে এম নূরুল হুদা কমিশনের অধীনে বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল অংশ নিলেও একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে দলটির পক্ষ থেকে রাতের ভোট হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। যদিও হুদা কমিশনের পক্ষ থেকে অভিযোগ বারবারই অস্বীকার করা হয়েছে। তবে ব্যাপক কারচুপির কারণে আগের কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত বেশিরভাগ নির্বাচনেই অংশ নেয়নি দলটি। ফলে স্থানীয় সব নির্বাচনই একতরফা হয়ে পড়ে।
তারা বলছেন, আগের ইসির বিদায় নেওয়ার আগে সারা দেশে পরিচালিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতায় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। অথচ কমিশনের পক্ষ থেকে এসব প্রাণহানীর দায় সবসময় অস্বীকার করা হয়েছে। তারা বারবার বলেছে কেন্দ্রে বাইরে সহিংসতার দায় ইসির নয়। এসব সহিংসতাকে পাত্তা না দিয়ে কমিশন দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তলানিতে নিয়ে গেছে। সেইসঙ্গে কমিশন জনগণ ও ভোটারদের আস্থা পুরোপুরি হারিয়েছে।
তারা বলেন, নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজ হলো কেন্দ্রে ভোটারদের নির্বিঘ্ন উপস্থিতি। কোনো ভয়ভীতি ছাড়াই যেন একজন ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। এজন্য কেন্দ্র নিরাপত্তার পাশাপাশি ভোটারদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব ইসির। একজন ভোটারের জীবনে নিরাপত্তা না থাকে, তাহলে তিনি কীভাবে কেন্দ্রে যাবেন ভোট দিতে। বিষয় স্বীকার করেছেন খোদ নতুন নিয়োগ পাওয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।
তিনি নিয়োগ পাওয়ার পর এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনে সহিংসতার বিষয় কষ্ট দিয়েছে। এগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেখতে হবে। রাজনৈতিক নেতাদের এগুলো দেখতে হবে।
নির্বাচন বিশ্লেষক ড. আব্দুল আলীম নতুন ইসির চ্যালেঞ্জর বিষয়ে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশনকেও ‘বাড়তি চ্যালেঞ্জের’ মুখে পড়তে হবে। দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে মানুষের মধ্যে কিছু বির্তক রয়েছে। সেক্ষেত্রে স্বাধীনতার পর প্রথম আইনের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রপতি করে দিলেও রাজনৈতিক দলসহ সবার আস্থা অর্জন করাটাই চ্যালেঞ্জ।
কাজ দেখিয়ে আস্থা অর্জন করা। সব মহলের আস্থা অর্জন করতে হবে, সহিংসতা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং কমিশনে নিজেদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে হবে। জনগণকে আরো সম্পৃক্ত করতে হবে। সেইসঙ্গে ভালোভাবে নির্বাচন করতে পারলে ‘নির্বাচন ব্যবস্থাপনা’ নিয়ে সমালোচনা হয়তো কোনো পক্ষ থেকে আসবে না বলে মনে করেন তিনি। জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার (জানিপপ) চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ এ বিষয়ে বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করাই হবে নতুন ইসির চ্যালেঞ্জ।