logo
আপডেট : ১ মার্চ, ২০২২ ০৯:৪৪
দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ চায় না বিশ্ব

দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ চায় না বিশ্ব

কিয়েভের উপকণ্ঠে বিস্ফোরণ। ছবি- সংগৃহীত

বিশ্ব বর্তমানে নতুন একটি স্নায়ু যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। ইউক্রেন নিয়ে পুতিন যা করছে তার বিরুদ্ধে প্রায় সারাবিশ্ব একাট্টা অবস্থানে রয়েছে। ইউক্রেনে আক্রমণ শুরুর পরপরই গত ২৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, এই দিনটি নিঃসন্দেহে রাশিয়ার জন্য শীতলতম দিন হতে যাচ্ছে। কিন্তু গত কয়েক দিনের বিশ্ব প্রতিক্রিয়া লক্ষ করলে দেখা যাচ্ছে, মস্কোর প্রতি নিন্দা জানানো দেশের তালিকা খুবই ছোট।

এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ দুটি দেশ চীন এবং ভারত রুশ আক্রমণের নিন্দায় তেমন সরব নয়। আফ্রিকার বৃহত্তম দেশ নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং মিসরের আচরণও ছিল একই রকম। ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে আনা নিন্দা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় ব্রাজিল। তার আগ পর্যন্ত রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান সম্পর্কে তাদের অবস্থা বেশ নড়বড়ে ছিল।

নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে ১১ দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। অনেক সদস্য রাষ্ট্র দ্ব্যর্থহীন ভাষায় রাশিয়ার নিন্দা জানায়নি। বেশির ভাগ দেশই সহিংসতা বন্ধের দাবি জানিয়ে আলোচনার টেবিলে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হচ্ছে জেনেও কেন অর্থনৈতিক ও কৌশলগতভাবে ঐক্যবদ্ধ ও প্রভাবশালী পশ্চিমাবিশ্ব তা থামাতে বা নিন্দা প্রস্তাবে সর্বজনীন সম্মতি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে। কেন এমন প্রতিক্রিয়া, তা নিয়ে সবার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে।

বেশিরভাগ দেশের সন্দেহ ও ভয় হচ্ছে- এটি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে আরেকটি স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর শেষ পরীক্ষা। কিয়েভ এখানে ভুক্তভুগী এবং রাশিয়া আক্রমণকারী। কিন্তু অনেকের মতে, এই খেলায় ওয়াশিংটন একেবারেই নির্দোষ- এমনটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। আমরা যদি নিজেই নিজেকে একজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করি তাহলে বিভিন্ন অজুহাতে অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার দায়ে যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাড় করাব- এটা নিশ্চিত।

রাশিয়া এবং চীনের মতো দেশেও যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে পিছপা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দ্বৈত ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার অভিযোগও কম নয়। আগ্রাসন, দখলদারিত্ব ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে মিত্রদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এক নীতি, বাকিদের জন্য অন্যরকম- স্নায়ুযুদ্ধের সময় যেমনটি হয়েছিল।

ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের উত্তরাঞ্চলের ওপর হয়তো তেমন প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলকে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেবে। মস্কো ও ওয়াশিংটন ছাড়া যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে এই দ্বন্দ্বকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে আর্থিক ক্ষেত্র থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে নিজেদের ফায়দা তুলে নেবে। দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ কারো জন্যই সুফল বয়ে আনবে না। বিশেষ করে বর্তমানের আন্তঃসংযোগ ও আন্তঃনির্ভর বিশ্ব যদি গভীরভাবে মেরুকৃত হয়ে যায় তাহলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ।

কারণ এর একদিকে রয়েছে পশ্চিমাদেশগুলো ও ন্যাটো। অন্যদিকে থাকবে রাশিয়া, চীন এবং অন্যরা। এটা একক কোনো রাষ্ট্র নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। গত শতাব্দীর ৮০ দশকের শেষদিকে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়। এরপর অধিকাংশ দেশ নিজেদের অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য এনেছে। তারা তাদের দেশ গঠনের ক্ষেত্রে পরাশক্তি রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন-চীনকে প্রাধান্য দেয়নি।

ইউক্রেন ইস্যুতে দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ দুয়ারে কড়া নাড়ছে। বর্তমানে অনেক দেশই ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণের ক্ষেত্রে নিজেদের স্বার্থ খুঁজবে। পক্ষ বাছাইয়ে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করছে বিশ^। কারণ, কিছু দেশ গম, জ¦ালানি এবং সামরিক সরঞ্জামের ক্ষেত্রে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। বিনিয়োগ, ঋণ এবং বাণিজ্যের দিক দিয়ে কিছু কিছু দেশকে চীনের ওপর নির্ভর করতে হয়।

গত কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র বারবার দাবি করে আসছে, সংকটের সময় যেন দেশগুলো তার পাশে দাঁড়ায়। তা না হলে তাদের এজন্য মূল্য দিতে হবে। নিউইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনে ৯/১১-এর হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর সময় সব রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিল- আমরা ভেবে নেব হয় তুমি আমাদের সঙ্গে আছে বা আমাদের বিপক্ষে।

এর কিছুদিন পর ইরান, ইরাক ও উত্তর কোরিয়াকে বিশ্বের অশুভ শক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে যুক্তরাষ্ট্র। কিছুদিনের মধ্যে বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি দাবি করে ইরাক আক্রমণের প্রস্তুতি নেয় যুক্তরাষ্ট্র।

পরের দশকেই ওয়াশিংটন চীনের ওপর চাপ বাড়ানো শুরু করে। বাণিজ্যিক মিত্রদের পাশে থাকতে বলে। তা না হলে এর জন্য ভুগতে হবে বলে সতর্ক করে দেয়। এসব ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনও একই পথে হেঁটেছে। জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যারা জাতিসংঘে আনা নিন্দা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছেন তাদের তালিকা হচ্ছে বলেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয়ে যাওয়া, চীনের উত্থান এবং প্রতিশোধ নিতে রাশিয়ার ফিরে আসা সত্ত্বেও ওয়াশিংটনের জবরদস্তিমূলক সুর সত্যিই বেশ অদ্ভুত শোনাচ্ছে। ক্লান্ত যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া হয়ে দেশগুলোকে বিকল্প পথে যেতে প্ররোচনা দিয়ে যাচ্ছে। আফগানিস্তানে অপমানিত হয়ে ফিরে যাওয়া এবং ইরাক যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর কোনো দেশই আর বিশ্বাস করে না যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাহায্য, সুরক্ষা বা রক্ষা করবে। সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া এবং বিশ্বের অন্যান্য উত্তেজনাপূর্ণ অঞ্চলেও তারা ভুল সিদ্ধান্তের মাসুল দিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে ইউক্রেনকে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর সামনে ছেড়ে দেওয়াটা যুক্তরাষ্ট্রের মোটেও ঠিক হবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

কয়েক দশক ধরেই বিশ্ব তার সরলতা হারিয়েছে। ওয়াশিংটনের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের স্লোগানে এখন আর কেউ উদ্ভুদ্ধ হয় না। কারণ এর পক্ষ-বিপক্ষ উভয়েই যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। ইউক্রেন আক্রমণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাইডেন মার্কিন নাগরিকদের আশ্বস্ত করে বলেছে-আমরা যুদ্ধে জড়াব না, আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে চাই না এবং জ্বালানির জন্য অতিরিক্ত মূল্য দিতে রাজি নই। এরপর এক বিশ্লেষক বিদ্রুপের সুরে বলেছে, ইউক্রেনের শেষ সৈন্যটি বেঁচে থাকা পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে যাবে।

খুব শিগগিরই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিরপেক্ষ আন্দোলনের একটি উদ্যোগ নেবে- এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় শতাধিক দেশ জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। তবে এটা স্পষ্ট যে, বর্তমানে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য মেরুকরণের চেয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা অনেক বেশি প্রয়োজন।

দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করবে এটা নিশ্চিত। এছাড়া মহামারির মতো সংকট মোকাবিলা, খাদ্য নিরাপত্তা, দারিদ্র্যবিমোচন এবং রোগ নির্মূলের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক সহযোগিতাকে বাধাগ্রস্ত করবে। আবারো শুরু হবে অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং বিশ্বকে পরমাণু যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিবে।

শান্তিতে সম্প্রতি নোবেলজয়ীর কথার সুর ধরে বলা যায়, পরমাণুর কাছে মানবতার বিনাশ হওয়া থেকে বিশ^ শুধুমাত্র একটি আবেগপূর্ণ উত্তেজনা থেকে দূরে রয়েছে। এককথায় বলা যায়- দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধে মানবিক দুর্ভোগ হবে অবর্ণনীয়, অর্থনীতিতে ধস নামবে এবং বৈশ্বিক সংকট হবে অগণনীয়।

তবুও যুদ্ধ ও আগ্রাসনের জন্য রাশিয়াকে শাস্তি দিতে অনড় ওয়াশিংটন। তারা মনে করছে, আফগানিস্তানের মতো ইউক্রেনও রাশিয়ার দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে। কারো কারো মতে, বর্তমান সময়টা বাইডেনকে ট্রুম্যান (যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান) যুগে নিয়ে গেছে। আজ থেকে ৭৫ বছর আগে পূর্বসূরিদের দেখানো পথ অনুসরণ করে বাইডেন রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণের কৌশল অবলম্বন করতে যাচ্ছে।

কিন্তু তাতেও ইউরোপ আর তার এগিয়ে যাওয়ার পথ ফিরে পাবে না। তখন যে পরিস্থিতি দাঁড়াবে তাতে যুদ্ধ সীমিত হবে- এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী স্নায়ুযুদ্ধে রূপ নেবে, যা বিশ্বকে পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। ইতোমধ্যে ন্যাটোর একটি যৌথ বিবৃতি হুমকি বিবেচিত হওয়ায় রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন তার পারমাণবিক প্রতিরোধ বাহিনীকে উচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।

ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দাবিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বেশ সোচ্চার। যদিও রাশিয়া ও ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কাছে ইউক্রেন একটি গুরুত্বহীন রাষ্ট্র। তারপরও অবিলম্বে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানো, কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানানো এবং সর্বোপরি ইউরোপের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্যে অবিলম্বে সংলাপ জরুরি বলে মনে করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। এটা ঠিক যে, রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, তবে শান্তির পথ যাতে খোলা থাকে সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। নতুন স্নায়ুযুদ্ধের বেদিতে ইউক্রেনকে বলি দেওয়ার কোনো অধিকার পশ্চিমাদের নেই।

মোমেনা আক্তার পপি; আলজাজিরা অবলম্বনে