‘স্যার, আপনাকে সালাম দিয়েছেন..।’ প্রতি মাসের শুরুতে এভাবেই একটি কল আসে সিসা লাউঞ্জ মালিকদের কাছে। তারপরই সালামের জবাব হিসেবে নগদ টাকা পৌঁছে দেওয়া হয় যথাস্থানে। এভাবেই দিনের পর দিন নির্বিঘ্নে চলছে অবৈধ সিসা লাউঞ্জ। এসব লাউঞ্জে অভিযানের আগেই খবর পৌঁছে যায় মালিকদের কাছে। মুহূর্তেই সব ঠিকটাক। উধাও হয়ে যায় নিকোটিন, অ্যালকোহল। এমনকি কোনো কোনো সিসা লাউঞ্জ বন্ধ পান অভিযানকারীরা।
এ অভিযানগুলো হয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নির্দেশে। অভিযানে সিনিয়র অফিসারদের কেউ নিজে নেতৃত্বও দেন। অভিযোগ রয়েছে সরষের মাঝে ভূত থাকায় এসব অভিযান সফলতার মুখ দেখে খুব কম।
রাজধানীর বনানী, গুলশান, ধানমন্ডি ও মিরপুর এলাকায় সিসা বার বা লাউঞ্জ রয়েছে প্রায় অর্ধশত। এর মধ্যে শুধু বনানীতেই রয়েছে ২২টি। এসব সিসা বার থেকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের উৎকোচ আদায় করে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। বনানী এলাকার প্রতিটি সিসার বার বা লাউঞ্জ থেকে প্রতি মাসে অসাধু কর্তাদের পকেটে ঢুকে ৩৩ লাখ টাকা। প্রায় একই অঙ্কের টাকা যায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সংশ্লষ্ট অসাধু কিছু কর্মকর্তার হাতে।
সব মিলিয়ে বনানী এলাকা থেকেই সিসা লাউঞ্জ থেকে উৎকোচ আদায় হয় ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা। রাজধানীর সব লাউঞ্জ থেকে প্রায় কোটি টাকা উৎকোচের মাধ্যমে সিসা নামের এ মাদক সেবনের সুযোগ করে দিচ্ছে কিছু অসাধু কর্মকর্তা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরর সুরক্ষাসেবা বিভাগে সচিব হিসেবে মো. মোকাব্বির হোসেন যোগদানের পরই পাল্টে যায় চিত্র। কঠোর হন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মাহপরিচালক। কড়াকড়ি আরোপ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পুলিশ। অভিযানের কারণে দৃশ্যত বন্ধ হলেও আড়ালে রয়েছে ভিন্নগল্প।
বহুতল ভবনের নিচে গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন নিরাপত্তাকর্মী। অচেনা কাউকে দেখলেই জানতে চান, কোথায় যাবেন? জবাব যদি হয় সিসা লাউঞ্জে, তাহলে তিনি জানিয়ে দেন লাউঞ্জ বন্ধ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। লাউঞ্জ চলছে ঠিকই। বনানীর ডি-ব্লকের ১০ নম্বর রোডের ৬৬ নম্বর আরগিলা নামে সিসা লাউঞ্জ। রাস্তা থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই এটি খোলা। সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই প্রথম রুমটি দেখেই চমকে উঠতে হবে।
বর্ণিল আধো আলো-অন্ধকারে সিসার হুক্কায় সুখটান দিচ্ছেন তরুণী-তরুণীরা। পাশাপাশি বসে টানছে তারা। ধোঁয়া উড়ছে রুমজুড়ে। সর্বত্র ছড়িয়ে আছে মিষ্টি ঘ্রাণ। বারান্দার পাশে একটি রুম। প্রায় বন্ধ অবস্থা। লাউঞ্জ কর্তৃপক্ষের পরিচিত কোনো জুটি চাইলেই রুমটি ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। সিসা টানার পাশাপাশি আবাসিক হিসেবে ব্যবহৃত হয় আরগিলার এ রুমটি। এজন্য অতিরিক্ত চার্জ দিতে হয় লাউঞ্জ কর্তৃপক্ষকে। একান্তে সময় কাটানোর জন্য অনেকেই তাই আরগিলা মুখো হন।
বন্ধু-বান্ধবীদের সান্নিধ্যকে আরো নৈকট্যে নিতে প্রায় লাউঞ্জেই রয়েছে ‘কেবিন সিস্টেম’ কেউ কেউ এটিকে গুছি বলে থাকেন। হাজার-হাজার টাকা ব্যয় করে এসব লাউঞ্জে সময় কাটান ধনাঢ্য পরিবারের প্রাপ্ত-অপ্রাপ্ত বয়সি ছেলেমেয়েরা।
সূত্র মতে, সাটার নামিয়ে, অচেনাদের বন্ধ দেখিয়ে চেনা-জানা গ্রাহককে সেবা দিচ্ছে লাউঞ্জগুলো। কৌশলে চলছে, বনানীর ই-ব্লকের ১২ নম্বর রোডের আল গ্রিসিনো। ১০ তলায় লিফট থেকে নামতেই লাল সোফা, আধো আলো-আঁধারে মানুষের ভিড় দেখা গেছে গ্রিসিনোয়। সেখানে দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছে কোনো ঝামেলা হবে কিনা, জানতে চাইলে মৃদু হেসে জানান, ঝামেলা করবে কে, সব ম্যানেজ করেই চালাচ্ছি। অভিযান হলে আগেই খবর আসবে। কোনো ঝামেলা নেই স্যার। এটার মালিক আনোয়ার নামে এক ব্যক্তি। বিকাল থেকে রাত ২টা পর্যন্ত গ্রিসিনো খোলা থাকে পরিচিত গ্রাহকের জন্য।
অবশ্য পুলিশের ভূমিকার বড় উদাহরণ হচ্ছে, বনানী থানার নাগের ডগাতে দীর্ঘদিন থেকেই চলছে কিউডিএস নামে সিসা লাউঞ্জ। বনানীর ১১ নম্বর সড়কের ৫৪ নম্বর ভবনের ষষ্ঠ তলায় রয়েছে ফ্লোর সিক্স রিলোডেট, বনানী কবরস্থানসংলগ্ন ফিউশান হান্ট, জি-ব্লকের ১১ নম্বর রোডে রয়েছে ব্ল্যাক ব্রিচ কিচেন অ্যান্ড লাউঞ্জ, গোল্ডেন টিউলিপ, ১১ নম্বর রোডে এআর লাউঞ্জ, ১১ নম্বর রোডের এইচ-ব্লকে প্লাটিনাম গ্র্যান্ড আবাসিক হোটেলেও রয়েছে সিসা লাউঞ্জ।
ওই রোডের ১৫৩ নম্বর বাড়িতে রয়েছে মিন্ট আল্ট্রা লাউঞ্জ। মিন্ট আল্ট্রায় শুধু সিসা নয়, সরাসরি মদ ও বিয়ার বিক্রি করা হয়। এ লাউঞ্জের মালিক শাতিল নামে এক ব্যক্তি। দীর্ঘদিন থেকেই সিসা-বাণিজ্য করছেন তিনি। তার মাধ্যমেই নতুনরা এ পথে হাঁটার সুযোগ পান সহজেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ম্যানেজ করার দায়িত্বও থাকে তার কাঁধে। তার মাধ্যমেই টাকা পৌঁছানো হয় অসাধু পুলিশের কাছে।
সূত্রমতে, প্রতি মাসের ৫ থেকে ১০ তারিখের মধ্যে উৎকোচ পৌঁছে দিতে হয় যথাস্থানে। দেরি হলেই তার হোয়াটসঅ্যাপে কল দেন আমিনুল নামে এক ব্যক্তি। সংক্ষেপে বলেন, ‘স্যার, আপনাকে সালাম দিয়েছেন।’
২০২০ সালের আগে বনানী এলাকার লাউঞ্জগুলো থেকে পুলিশের নামে উৎকোচ আদায় হতো ৫০ হাজার টাকা করে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বনানী থানার ওসির দায়িত্ব পান নুরে আযম মিয়া। ওই সময়ে বনানীতে ফ্লোর সিক্স রিলোডেট, মিন্ট আল্ট্রা লাউঞ্জ, পেট্টাস, ফারহান নাইটসসহ প্রায় ১০টি লাউঞ্জ ছিল। ২০২০ সালের পর দ্রুত বনানীতে সিসা লাউঞ্জ বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে উৎকোচের পরিমাণও।
সূত্রমতে, প্রতিটি লাউঞ্জ থেকে মাসে ১ লাখ টাকা আদায় করা হতো পুলিশের নামে। পরে এর পরিমাণ বেড়ে প্রতিটি লাউঞ্জ থেকে আদায় করা হচ্ছে দেড় লাখ টাকা করে। সিসা লাউঞ্জ থেকে পুলিশের নামে উৎকোচ আদায় প্রসঙ্গে বনানী থানার ওসি নুরে আযম মিয়া বলেন, পুলিশ টাকা নিচ্ছে, বিষয়টি জানা নেই। ২০২০ সালের পর কেন বনানীতে দ্রুত সিসা লাউঞ্জ বাড়ছে, তা-ও বুঝতে পারছেন না বলে জানান ওসি।
সূত্রমতে, শাহীন নামে এক ব্যক্তি প্রতিটি লাউঞ্জ থেকে ৫ হাজার টাকা করে নেন। অভিযানের আগাম খবর জানিয়ে মালিকদের সতর্ক করার দায়িত্ব তার। এই নামে বনানীন থানায় একজন এসআই রয়েছেন দীর্ঘ ৫ বছর ধরে। কোনোভাবেই এই থানা এলাকা ছাড়তে চান না তিনি। এখানে থাকতে তদবির করেছেন বিভিন্ন সময়ে। আছেন বহাল তবিয়তে।
লাউঞ্জ থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, এটা ভুল তথ্য। আমি টাকা নিই না। একইভাবে নিকেতনে মিরাজ, গুলশানের আরএম সেন্টারের মন্টানা লাউঞ্জ, ডাউন টাউন ও কোর্ট ইয়ার্ড বাজারসহ গুলশানে পরিচালিত হচ্ছে ছয়টি লাউঞ্জ। লাউঞ্জ রয়েছে ধানমন্ডি ও মিরপুরে।
গুলশান বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সিসা লাউঞ্জ থেকে পুলিশ টাকা নিচ্ছে, এরকম তথ্য-প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে এটা সত্য প্রকাশ্যে অভিযান করতে গেলে সিসা লাউঞ্জের মালিকরা টের পেয়ে যায়। তাই আমি যখনই অভিযানে নামি তা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গোপনে। অভিযান করার পরও লাউঞ্জের সংখ্যা না কমার কারণ হিসেবে ডিসি জানান, মালিকরা স্থান পরিবর্তন করে।
সূত্রমতে, বনানীর এআর লাউঞ্জ, ১১ নম্বর রোডের টিজেএস লাউঞ্জ বেশ কয়েক লাউঞ্জে রাতভর ডিজেসহ নানা পার্টি হতো। এআর লাউঞ্জে চার-পাঁচটি রুম আছে অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর জন্য। সম্প্রতি সিসা লাউঞ্জে কড়াকড়ির ফলে বিকল্প পথে হাঁটছেন মালিকপক্ষ। এটি মাদক নয় বা নিকোটিনের পরিমাণ দুই পয়েন্টের নিচে রয়েছে, এমনটি প্রমাণ করতে চেষ্টা করছেন তারা।
২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর থেকে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮’ কার্যকর হয়েছে। ওই নতুন আইনে সিসাকে মাদকদ্রব্যের ‘খ’ শ্রেণির তালিকাভুক্ত করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ আইনে মাদক সম্পর্কিত অপরাধ প্রমাণিত হলে ন্যূনতম এক বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড ও নগদ অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। এসব বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আব্দস সবুর মণ্ডল বলেন, এ বিষয়ে আমরা অত্যন্ত কঠোর। অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ তথ্য প্রশান পেলেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।