মানুষের ভাষা আছে, অন্যান্য প্রাণীর ভাষা বলতে কিছু নেই। মানুষ সামাজিক জীব। প্রাণিজগতের অন্যদের সঙ্গে এখানেই মানুষের মূল পার্থক্য। বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশ আজ এক সুতোয় গাঁথা পড়ে গেছে। কোনো কিছুকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার পথ নেই। ইতিহাসপাঠে জানা যায়, বাঙালি জাতি মূলত ভাষাভিত্তিক জাতি।
যতদূর জানা গেছে, অতি প্রাচীনকালে ‘বং’ ভাষাভাষি এক জনগোষ্ঠী যে এলাকায় বসতি স্থাপন করেছিল, সেই এলাকা ধীরে ধীরে পরিচিতি লাভ করে ‘বং’ জনপদ হিসেবে। ‘বং’ জনপদের পাশাপাশি আরো কিছু জনপদ গড়ে উঠেছিল, যেমন- গৌড়, রাঢ়, পুণ্ড্র, সূম্ম, তাম্রলিপ্ত, সমতট ইত্যাদি। জনপদগুলোর মধ্যে শক্তির লড়াই ছিল, সে লড়াইয়ে ধীরে ধীরে ‘বং’ জনপদ অন্যান্য জনপদের ওপরে আধিপত্য বিস্তার লাভ করতে সমর্থ হয়। কালের গতিধারায় ‘বং’ জনপদ অন্যান্য জনপদকে এক পর্যায়ে গ্রাস করে ফেলে। সেই ‘বং’ জনপদেরই এ কালের বিবর্তিত রূপ ‘বাংআলদেশ’ এবং সবশেষে বাংলাদেশ।
অতীত ইতিহাস পাঠে জানা যায়, বাংলাদেশের উর্বর মাটি বিদেশিদের কাছে ছিল অতি লোভনীয়। যে কারণে যুগ যুগ ধরে দেশটি বিদেশিদের হামলার শিকার হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তার কবিতায় উল্লেখ করেছেন, ‘হেথা আর্য হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন। শক হুনদল, পাঠান মোঘল এক দেহে হলো লীন’। কতিপয় উদাহরণ এখানে তুলে ধরা যায়। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে দেশটি অশোক শাসনের অধীন ছিল। অশোক শাসনের পর গুপ্ত শাসন, এরপর পালদের শাসন। পালদের শাসনকালে বাংলা ভাষার প্রসার ঘটে, তার প্রমাণ বাংলা ভাষায় রচিত চর্যাপদ। পালদের পর এসেছে সেনেরা। সেনদের সময় সংস্কৃত ভাষা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। বাংলা ভাষার প্রতি তারা অবজ্ঞা দেখিয়েছে। সেনদের পর দেশটি মুসলিম শাসকদের অধীনে আসে ১২০৩/৪ সালের দিকে। মুসলিম শাসকেরা নিজেদের ফারসি ভাষাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা করে। ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ইংরেজদের দখলে ছিল।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের বিভক্তি ঘটে। জন্ম লাভ করে পাকিস্তান নামের একটি নতুন রাষ্ট্র। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলার মানুষ বিশ্বাস করেছিল, এবার তারা স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলগ্নেই দেখা দেয় রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমস্যা। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ঢাকায় এসে যখন ঘোষণা দেন- ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’, এই ঘোষণার বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক বাঙালি জাতি তার ভাষার প্রতি সব সময় আবেগপ্রবণ। নিজের ভাষার অবমাননা এ জাতি কখনো সহজভাবে মেনে নতে পারেনি। নিজের মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৫২ সালে এদেশের মানুষকে জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। ভাষাশহিদদের রক্তের দিকে তাকিয়ে বাঙালি জাতি নতুন করে আত্ম আবিষ্কারের চেষ্টা চালায়। প্রাচীন সেন শাসনকাল থেকে ব্রিটিশ শাসনকাল পর্যন্ত বাঙালি জাতি হাজার বছর ধরে পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ ছিল, সে কারণে বাঙালি তার প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পায়নি বটে, তবে নিজের মাতৃভাষাকে বাঙালি জাতি সব সময় অন্তরে ধারণ করে রেখেছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হাজার বছরের বাঙালি পরিচয় বাদ দিয়ে তাকে পরিচয় দিতে হয় পাকিস্তানি জাতি বলে। তার মাতৃভাষা বাংলা রাষ্ট্রভাষা হলো না, হাজার বছরের বাঙালি জাতীয়তা তার হারিয়ে গেল। তবে তার স্বাধীনতা থাকল কোথায়? তার মনে নানা প্রশ্ন। সে যদি বাঙালি, তবে তার রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে না কেন? অন্যদিকে তার জাতীয়তা যদি পাকিস্তানি, সেক্ষেত্রে উর্দুকে সে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে পারছে না কেন? তার মধ্যে দেখা দেয় মারাত্মক আত্মপরিচয়ের সংকট।
১৯৫২ সালে ভাষাশহিদদের রক্ত বাঙালি জাতিকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৯৫৪ সালে গঠন করে যুক্তফ্রন্ট। ১৯৫৪ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২১ দফার যে নির্বাচনি ইশতেহার প্রচার করে, তার মধ্যে বাংলা ভাষার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়। সেখানে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয়, যুক্তফ্রন্ট রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে পারলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা হবে। যে বর্ধমান হাউজ থেকে ছাত্রদের মিছিলের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সেই বর্ধমান হাউজকে বাংলা একাডেমি করা হবে। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হবে। বাংলা ভাষার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে পূর্ব বাংলার মানুষ বিপুল ভোটের মাধ্যমে যুক্তফ্রন্টকে জয়যুক্ত করে।
১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হলেও পশ্চিম পাকিস্তানিদের নানারকম ষড়যন্ত্রের কারণে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেনি। আইয়ুব খান অস্ত্রের বলে পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করার পর থেকে তার সামরিক শাসনের সব আক্রোশ শেখ মুজিবের ওপর একে একে গিয়ে পড়তে থাকে। আইয়ুবের এক দশকের ঊর্ধ্বকাল শাসনামলে শেখ মুজিব প্রায় আট বছর কারাগারে আবদ্ধ থাকেন। কোনো কোনো সময় তার কারাবাসের মেয়াদ এক বছরের চেয়ে দীর্ঘায়িত হয়। এ ছাড়া অসংখ্য মামলা চাপিয়ে তাকে হয়রানি করা হতে থাকে। কিন্তু এতে মুজিবকে দমানো যায়নি। যখনই তিনি মুক্তি পেয়েছেন তখনই পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে এবং আইয়ুবীয় স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, ভাষণ দিয়েছেন। শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালে তার বিখ্যাত ছয় দফা দাবি ঘোষণা করেন।
ছয় দফাকে একটু নিবিষ্টচিত্তে বিশ্লেষণ করলে সহজেই অনুভব করা যায়, এর মধ্যে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার বীজ শুধু লুকিয়ে নেই, তা অঙ্কুরিত হয়েছে। সুচতুর আইয়ুব খান ও তার অনুসারীগণ উপলব্ধি করলেন যে, শেখ মুজিবকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই, অর্থাৎ তাকে ফাঁসিতে লটকাতে হবে। এই উদ্দেশ্যে ১৯৬৮ সালের ২১ এপ্রিল একটি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি এসএ রহমানের নেতৃত্বে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। সে মামলার নামকরণ হয় রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব।
ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা দানা বেঁধে উঠতে থাকে। ষাটের দশকের স্লোগানের ভাষা- তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা। তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি। আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে স্লোগান ওঠে- ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।’ স্লোগানের ভাষা শেষ পর্যন্ত সত্য হয়ে ওঠে। ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের ফলে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। শেখ মুজিব জেলখানা থেকে মুক্ত হয়ে এসে স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিতে থাকেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের এক ঐতিহাসিক ভাষণে শেখ মুজিব বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ভাষণটি তিনি শেষ করেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের পর পাকিস্তানের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যায়। জন্ম হয় ভাষাভিত্তিক স্বাধীন বাংলাদেশের।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় আমি গ্রামের স্কুলে পড়তাম। ভাষা আন্দোলন গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছিল। গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে আমরা মিছিল করতাম আর স্লোগান দিতাম ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। কৃষকেরা আমাদের মিছিলে যোগদান করতেন। স্লোগানের ভাষা ভুল করে তারা বলে ফেলত ‘বাংলা ভাষা রাষ্ট্র চাই’। আমরা একসময় চেয়েছিলাম রাষ্ট্রভাষা বাংলা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা পেয়ে গেলাম বাংলা ভাষার রাষ্ট্র। বাংলা ভাষার এখানেই বড় বিজয়, এখানেই বাংলা ভাষার চরম সফলতা।
২১ শে ফেব্রুয়ারি, বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের এ ইতিহাস অগ্নিগর্ভ। আমাদের জাতীয় জীবন মূলত একুশের দান। একুশ আমাদের দিয়েছে নব প্রেরণা। বাংলা শিল্প-সাহিত্যের ধমনিতে নিত্য সক্রিয় একুশের চেতনা। শুধু বাঙালি নয়, বিশ্বের প্রতিটি জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা, স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও মানুষের বাঁচার দাবির সংগ্রামের দুর্জয় অনুপ্রেরণা সৃষ্টির চির অনির্বাণ শিখার দীপ্তিতে দিগন্ত উদ্ভাসিত করেছে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, এখন এটি সারা বিশ্বের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
বাংলা ভাষা বাঙালি ঐতিহ্যের পরিচয়কে দৃঢ় করেছে। বাংলা ভাষার রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে সম্মানের আসন লাভ করেছে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি এবং ২০১০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হবে’ প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন পর্বের এ শুরু বড় আনন্দের, বড় গৌরবের।
১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে প্রেরণা দিয়েছিল একুশ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের রক্তরাঙা ইতিহাস। পৃথিবীর আর কোনো দেশে মাতৃভাষার জন্য এভাবে আন্দোলন হয়নি। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির মাঝে নবচেতনার জন্ম হয়। নবচেতনা রূপ নেয় স্বাধিকারের স্বপ্নে। আর সে পথ ধরেই একাত্তরে আসে বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীন বাংলাদেশ। মায়ের ভাষা বাংলার জন্য রক্ত ঢেলে বাঙালির যে সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল তার পথ ধরেই আমরা পেয়েছি আজকের স্বাধীন, সার্বভৌম ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
“ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির মাঝে নবচেতনার জন্ম হয়। নবচেতনা রূপ নেয় স্বাধিকারের স্বপ্নে। আর সে পথ ধরেই একাত্তরে আসে বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীন বাংলাদেশ। মায়ের ভাষা বাংলার জন্য রক্ত ঢেলে বাঙালির যে সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল তার পথ ধরেই আমরা পেয়েছি আজকের স্বাধীন, সার্বভৌম ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ”
লেখক: সাবেক উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়