logo
আপডেট : ১ মার্চ, ২০২২ ১৯:০৪
‘জয় বাংলা’ স্লোগান
মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি, বাঙালির প্রতিধ্বনি

মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি, বাঙালির প্রতিধ্বনি

‘জয় বাংলা’ মানেই ‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ’ মানেই ‘জয় বাংলা’

দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতেই মূলত ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্র বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নেয়। বিভক্ত দেশের অবিভক্ত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভৌগোলিক অবস্থান, সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যগত ও জাতিগত অস্তিত্বকে অস্বীকার করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কেবল ধর্মকে পুঁজি করে পূর্বাঞ্চলের জনগণকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ভাষাগতসহ সব ক্ষেত্রে শোষণ-নির্যাতন ও জাতিগত বৈষম্য সৃষ্টি করে অস্তিত্বহীন এক জাতিতে পরিণত করতে চেয়েছিল। শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির মুক্তির দিশারী হয়ে পূর্ববাংলার মানুষকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক রাখিবন্ধনে আবদ্ধ করে দীর্ঘ ২৩ বছরের ঔপনিবেশিক শোষণ, নির্যাতন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেন প্রতিবাদে। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-র ছয়দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ধাপে ধাপে রূপ নেয় স্বাধীনতার সংগ্রামে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) উত্তাল জনসমুদ্রে বজ্রকণ্ঠে তিনি ঘোষণা করেছিলেন: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত করে একই মোহনায় এক কাতারে দাঁড় করিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। এই একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করেছেন। আমরা আজ একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন পতাকার মালিক।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই বাংলার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশকে মুক্ত করতে। যাদের হাতে ছিল না কোনো আধুনিক অস্ত্র। পুঁজি বলতে কেবলই ছিল দেশ-মাতৃকাকে মুক্ত করার তীব্র বাসনা। তিনি যে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেটা বাঙালি জাতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় রণাঙ্গনে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান জনগণকে মুক্তি সংগ্রামে প্রবলভাবে প্রেরণা জুগিয়েছিল, বাঙালি জাতির হৃদয়ে শিহরণ জাগিয়েছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে যখন বলত- বল, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। এ রকম মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও বহু মুক্তিযোদ্ধা বলেছিলেন, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’।

হানাদার বাহিনী ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে এ বাংলার মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে রক্তের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিতে যে ভয়ঙ্কর খেলায় মত্ত হয়ে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, সেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৯৩ লাখ সদস্য মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে নিজের রিভলবার জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল তখনো এদেশের হৃদয়জুড়ে স্লোগান উঠেছিল ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাতীয় স্লোগান নির্দিষ্ট থাকে। যেমন- ভারতের জাতীয় স্লোগান ‘জয় হিন্দ’। তাদের প্রতিটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান, বেতার, টিভিতে অনুষ্ঠান শেষে ‘জয় হিন্দ’ উচ্চারিত হয়। তেমনি পাকিস্তানে উচ্চারিত হয় ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর কয়েক বছর বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকাকালে সব অনুষ্ঠানে ‘জয় বাংলা’ বলা হতো। ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। পাকিস্তানি মতাদর্শের অনুসারী সরকারগুলো পাকিস্তানি কায়দায় বলতে থাকে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। বিদায় নেয় ‘জয় বাংলা’। পরবর্তীকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান ‘জয় বাংলার’ সমর্থক এবং ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদে’র সমর্থকদের মধ্যে আপসরফা হিসেবে মধ্যবর্তী পন্থা অবলম্বন করে চালু করেন ‘বাংলাদেশ চিরজীবী হোক’। ব্যক্তিস্বার্থে আপস করা যায়, কিন্তু জাতীয় স্বার্থে কখনো নয়। বঙ্গবন্ধু কখনো আপসে বিশ্বাসী ছিলেন না।

‘জয় বাংলা’ আমাদের সংগ্রামী চেতনার ফসল। ‘জয় বাংলা’ জাতিসত্তা বিকাশের স্লোগান। আমাদের সংগ্রামী ঐতিহ্য রক্ষার জন্য ‘জয় বাংলা’। ‘জয় বাংলা’র জন্য এদেশের মানুষের অনেক রক্ত ঝরেছে। ত্রিশ লাখ লোক প্রাণ দিয়েছে। তিন লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছে। শত্রুর বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও বীর মুক্তিযোদ্ধারা ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করতে দ্বিধাবোধ করেনি। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি আমাদের শ্রেষ্ঠ জাতীয় সম্পদ। অন্য কোনো স্লোগান ‘জয় বাংলার’ বিকল্প হতে পারে না। তা করলে শহিদদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। যারা বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না, তারা ‘জয় বাংলা’ বলে না।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও স্বাধীনতা একই সূত্রে গাঁথা তিনটি শব্দ। বাঙালির মুক্তি আর গৌরবময় পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তারই নেতৃত্বে ও নির্দেশনায় স্বাধীনতার লাল-সবুজের পতাকাকে ছিনিয়ে এনেছিল এ বাংলার সূর্যসন্তানেরা। সেই থেকে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু ইতিহাসে সমার্থক শব্দ হয়ে আছে। এ ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানই মহান মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি; আমাদের দেশপ্রেম প্রকাশের ঐক্যের প্রতীক। এ স্লোগান কোনোভাবে কোনো একটি দলের স্লোগান হতে পারে না। এ স্লোগান আপামর জনসাধারণের স্লোগান, রাষ্ট্রীয় স্লোগান। সময় এসেছে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানকে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার।

২০১৭ সালে ড. বশির আহমেদ ও ২০১২ সালে আব্দুল বাতেন ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা করার জন্য হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। এরপর ২০২০ সালের ১৯ মার্চ বিচারপতি এফ আর এম নাজমুন আহসান এবং বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের দ্বৈত বেঞ্চ জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান করার রায় দেয়। তিন মাসের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার নির্দেশনা দেন। শেষ পর্যন্ত গত রোববার (২০ ফেব্রুয়ারি) দেশের সব সাংবিধানিক কর্মচারী, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব অনুষ্ঠানে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ানুল ইসলাম। অর্থাৎ, এখন থেকে দেশের সব সাংবিধানিক কর্মচারী, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব অনুষ্ঠানে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে হবে। এ সংবাদ খুশির সংবাদ, বড় আনন্দেও সংবাদ।

‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান বাঙালির চেতনায় মিশে আছে। এ স্লোগান যারা হৃদয়ে ধারণ করে না তারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। এ স্লোগান দল-মতের ঊর্ধ্বে। এ স্লোগান বাঙালির সম্পদ, জাতীয় সম্পদ। ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়েই মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার যুদ্ধ করেছেন। মহান যুদ্ধে এই স্লোগান দিয়েই এ দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। স্বাধীন রাষ্ট্রের গর্বিত বাঙালি হিসেবে আমরা আজ বিশে^র দরবারে আসীন। সুতরাং, এ স্লোগান দলীয় নয়, বরং জাতীয় স্লোগান, স্বাধীনতার স্লোগান। ‘জয় বাংলা’ বাঙালির রুধির ধারায় মিশে থাকা ‘রণধ্বনি’। ‘জয় বাংলা’ মানেই ‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ’ মানেই ‘জয় বাংলা’।

লেখক : সংসদ সদস্য ও তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য