logo
আপডেট : ২ মার্চ, ২০২২ ১০:৪৩
বাড়াতে হবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পরিধি
* কারিকুলামে মানসিক স্বাস্থ্য যুক্ত করতে হবে * মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য আলাদা ইউনিট দরকার * মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা কর্মক্ষমতা ব্যাহত করে * ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণেও মানসিক সমস্যা
নিখিল মানখিন

বাড়াতে হবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পরিধি

প্রতীকী ছবি

দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনা মহামারির এ বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আক্রান্ত ব্যক্তি ছাড়াও পরিবারের সদস্য, সমাজের নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের মানসিক স্বাস্থ্য এখন হুমকির মুখে। এ পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার পরিধি আরো বিস্তৃত করতে হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

করোনা মহামারি ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশে দেশে বিস্তর বৈষম্য ও নানাবিধ অসমতা রয়ে গেছে। এ অসমতা অর্থনৈতিক, সামাজিক এমনকি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেও। স্বাস্থ্যের দিকে যদি তাকাই, তাহলে মানসিক স্বাস্থ্য আরো বেশি উপেক্ষিত। অথচ সুখী-সমৃদ্ধ বৈষম্যহীন মানবিক বিশ্ব গড়তে শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘কেউ একদিনে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়ে না। জটিল পর্যায়ে যাওয়ার আগে নানা উপসর্গ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। আশপাশে থাকা লোকজনকেই উপসর্গ বুঝে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হতে হয়। পরিবারের কেউ মানসিক সমস্যায় পড়লে অভিভাবকদের নজরদারি বাড়াতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করতে হবে। সন্তানের পাশাপাশি মা-বাবা এবং অভিভাবকদের মানসিক চাপ থাকতে পারে। এক্ষেত্রে সন্তানদের নজরদারির বদলে উল্টো তাদের ওপর রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে। এ বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সর্বোপরি বাড়াতে হবে পারস্পরিক দায়িত্ববোধ ও সহমর্মিতা।

বাংলাদেশে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৮-১৯ এর তথ্য অনুযায়ী ৭ থেকে ১৭ বছর বয়সের শিশুদের ১৪ শতাংশ এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ মানসিক রোগে ভুগছে। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বিষণ্নতা রোগে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং উদ্বিগ্নতা রোগে ভুগছেন ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। মানসিক রোগে ভোগা শিশুদের ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ কোনো চিকিৎসা পান না। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে এ হার ৯২ দশমিক ৩ শতাংশ। করোনা পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালে এসব অবস্থার ব্যাপক অবনতি হয়েছে বলে বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে বলা হয়েছে। দেশের বিশাল জনসংখ্যার বিপরীতে মাত্র ২৫০ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও ৬০ জন ক্লিনিক্যাল মনোবিজ্ঞানী রয়েছেন। এ ছাড়া শিশু মনোবিজ্ঞানী একেবারে নেই বললেই চলে।

এদিকে, করোনা মহামারীতে পাল্টে গেছে বিশ্ব পরিস্থিতি। বদলে গেছে মানুষের জীবন ও জীবিকা। কর্মহীন হয়ে পড়ছে মানুষ। এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকার পর সীমিত পরিসরে খুলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালা। শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়া শিশু-কিশোর-তরুণদের আসক্তি বাড়ছে ইউটিউব, টিকটক, লাইকিসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সার্বিক এই পরিস্থিতি তাদের মনোজগতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এর প্রমাণ মিলেছে বিভিন্ন গবেষণায়। ২০২০ সালের ১৯-২৮ জুন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ৫০৯ জন শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা মূল্যায়ন নিয়ে গবেষণা হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাহিদা সালমার নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদনটি জার্মান পাবলিক হেলথ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। গবেষণার ফলে দেখা যায়, এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ হালকা, ৭২ দশমিক ৭ শতাংশ মধ্যম, ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ মাঝারিভাবে মারাত্মক এবং ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন।

করোনাকালে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে নাহিদা সালমার আরেকটি গবেষণা প্রকাশ পায়। ২০২০ সালের ২৫ এপ্রিল-৯ মে পর্যন্ত ১৫ বছরের কম বয়সী ৩৮৪ জনের ওপর এই জরিপ চালানো হয়। সেখানে দেখা যায়, ৪৩ শতাংশ শিশু অতি অল্প মানসিক অস্থিরতায় ভুগছে, ৩০ দশমিক ৫ শতাংশ অল্পভাবে, ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ পরিমিত মাঝারিভাবে, ৭ দশমিক ২ শতাংশ শিশু মারাত্মকভাবে অস্থিরতায় ভুগছে।

 

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম ভোরের আকাশকে বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সুনির্দিষ্টভাবে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চিকিৎসাবিষয়ক বিভিন্ন কোর্স, কারিকুলাম এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি সংযোজন করা জরুরি।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্যনীতির খসড়া মন্ত্রিসভায় উত্থাপনের অপেক্ষায় আছে বলে জানান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাসপাতাল অনু বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নাজমুল হক খান। তিনি বলেন, নীতি প্রণয়নের পর তা বাস্তবায়নে বাজেটের কোনো সমস্যা হবে না। জেলা হাসপাতালগুলোতে একজন চিকিৎসক ও দুজন নার্সকে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শ পেতে মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন তিনি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জাতীয় পরামর্শক (মানসিক স্বাস্থ্য) হাসিনা মমতাজ বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব নেই। তবে দক্ষ জনবল এবং বাজেটস্বল্পতা আছে। এ খাতে বিনিয়োগ কীভাবে বাড়ানো যায়, পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার সুযোগ তৈরিসহ বিভিন্ন কাজ চলমান আছে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ মেন্টাল হেলথ নেটওয়ার্কের সহসভাপতি অধ্যাপক ফারুক আলম বলেন, দেশে হাতে গোনা কয়েকটি হাসপাতালে মানসিক স্বাস্থ্যের বিভাগ ও দক্ষ জনবল আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি দেখভালের জন্য আলাদা ইউনিট গঠন করা দরকার। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে মানুষের কর্মক্ষমতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে বলে জানান অধ্যাপক ফারুক আলম।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার ভোরের আকাশকে বলেন, মানুষের মানসিকতা তৈরি হয় সামাজিক পরিবেশ থেকে। আমরা ইদানীং নৃশংসতা দেখছি মানুষের আচরণে। যোগাযোগ প্রযুক্তির এই যুগে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা খুব সহজ হয়ে গেছে। ফলে আমাদের দেশের বিভিন্ন ঘটনা ছাড়াও অন্যান্য দেশের ঘটনাবলিও মানুষের আচরণে প্রভাব বিস্তার করছে। প্রযুক্তিকে অপরাধ সংঘটনে ব্যবহার করছে মানুষ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক মাহফুজা খানম বলেন, দেশের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য আগের চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। এর কারণ সবকিছুই এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আবার মহামারীর এই সময়ে পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সব মিলিয়ে এক ধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। আর মানুষ বেশি দিন মানসিক চাপ নিয়ে চলতে পারে না। মানসিক চাপ বেড়ে গেলে মানুষের হরমোনাল ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।

এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মানুষ অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তখন তারা রাগারাগী ও হিংস্র আচরণ করে। আর এসবই এক ধরনের মানসিক রোগের বহিঃপ্রকাশ। কেউ কেউ রাগের বহিঃপ্রকাশ করে নিজের মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করে। আবার কেউ তা পারে না। যারা পারে না তারা চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটায়।

নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট বোর্ডের চেয়ারপারসন ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ডা. মো. গোলাম রাব্বানী বলেন, আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ক্রমেই ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে এবং মানুষের ভিতর দুর্বলতা বাড়ছে। দিন দিন মানুষের ভিতর উদ্বিগ্নতা, মানসিক চাপ ও বিষন্নতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০৩০ সালে মানুষের মধ্যকার বিষন্নতা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

মানুষের বিষন্নতা ও আবেগীয় তাড়নার ফলে তার মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। ফলে তাদের কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে। মহামারীতে আমরা সবাই স্থবির হয়ে যাচ্ছি। পৃথিবী থেকে যে পরিণতি আমরা লাভ করছি, সেভাবে আমাদের দায়ভারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য আমাদের অক্ষমতার যে দায়ভার তা মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতি নিতে এবং পরিকল্পনা করতে হবে। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে কাউন্সেলিং ও আলোচনাসহ প্রয়োজনীয় করণীয় ঠিক করতে হবে।

মানসিক সমস্যা হলে যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে, তা উল্লেখ করে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও মনোবিদ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। মন খারাপ থাকা, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা অনুভব করা, একই ধরনের চিন্তা বারবার মনে আসা বা একই কাজ বারবার করা, হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে মৃত্যুভয়ে ভীত হওয়া, কোনো কিছুতে আনন্দ অনুভব না করা, মেজাজ খিটখিটে থাকা, মনোযোগ কমে যাওয়া, সাধারণ বিষয় ভুলে যাওয়া, নিজেকে অপরাধী ভাবা, আগ্রাসী আচরণ কিংবা আত্মহত্যার চিন্তা মনে আসা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

এই মনোবিদ বলেন, সংকটময় মুহূর্তে আতঙ্কিত হওয়া ও মানসিক চাপে পড়ে হতাশাবোধ করা স্বাভাবিক। সবাইকে মানসিক চাপ মোকাবিলার দক্ষতা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, খাবার, ঘুম ও ব্যায়ামের সময়সূচি ঠিক রাখতে হবে। ঘরে থাকাকে বন্দি বলে মনে করা যাবে না। গুজবে কান দেওয়া যাবে না। করোনাভাইরাসের বাইরেও জীবন আছে- সেটা মাথায় রেখে পড়ালেখা করা, নিজের যত্ন নেওয়া, বই পড়া, মুভি দেখা বা নিজের ব্যক্তিগত কাজ চালিয়ে যেতে হবে।

দিনে দুবারের বেশি করোনাবিষয়ক সংবাদ দেখার প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন ডা. হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্মচর্চা করাও মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করবে। পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে মিলে ঘরের ছোটখাটো কাজ যেমন- রান্নায় সাহায্য করা, ঘর পরিস্কার করা ইত্যাদিতে অংশ নিতে হবে। বন্ধু ও সহপাঠীদের সঙ্গে সামাজিকভাবে সংযুক্ত থাকতে হবে। কিন্তু ইন্টারনেটে আসক্ত হওয়া চলবে না। বাবা-মাকে সন্তানের জন্য পৃথক করে সময় দিতে হবে। তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।