logo
আপডেট : ৩ মার্চ, ২০২২ ১১:৫৯
সিন্ডিকেটে সারের কৃত্রিম সংকট, বিপাকে কৃষক
মাইন উদ্দিন, খাগড়াছড়ি

সিন্ডিকেটে সারের কৃত্রিম সংকট, বিপাকে কৃষক

পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে সারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছে জেলার কৃষকরা। সংকটের অজুহাতে অতিরিক্ত দামে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। দাম বৃদ্ধির পেছনে সারের সংকটকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। তবে জেলায় পর্যাপ্ত সার রয়েছে বলে দাবি কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের।

কৃষকরা জানান, সারের দাম বেশি নেওয়া হলেও ডিলাররা তাদের কোনো রসিদ দিচ্ছেন না। কেউ কেউ রসিদ দিলেও তাতে সরকার নির্ধারিত দাম উল্লেখ করে তবেই স্বাক্ষর দিচ্ছেন। কেনা দাম উল্লেখ করতে বললে কৃষকদের কাছে সার বিক্রি করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

তারা আরো জানান, এ সংকট সার ডিলারদের দ্বারাই সৃষ্ট। মূলত অতিরিক্ত মুনাফার জন্যই এমন পরিস্থিতি তৈরি করছে ডিলারদের সিন্ডিকেট।

জেলায় সারের সংকট দেখিয়ে দাম বৃদ্ধি অবশ্য নতুনও নয়। বছরে অন্তত দু’বার এমন সংকট তৈরি করেন ব্যবসায়ীরা। তবে এ নিয়ে প্রশাসনের কোনো তদারকিও নেই। অনেকটা বাধ্য হয়েই সরকার নির্ধারিত দামের থেকে বেশিতে সার কিনছেন কৃষকরা।

চলতি রবি মৌসুমে খাগড়াছড়ির ৯ উপজেলায় হাইব্রিড ধান, উফশী ধান, স্থানীয় জাতের ধান, আলু, ভুট্টা, সরিষা, টমেটো, বেগুন, পেঁয়াজ, রসুন, ধনিয়াসহ নানান জাতের শাক-সবজির আবাদ করা হয়েছে। এসব রবি শস্য আবাদ করতে গিয়ে জমিতে টিএসপি, এমওপি, ডিএপি ও ইউরিয়া সার ব্যবহার করে থাকেন কৃষকরা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চাহিদা অনুযায়ী খাগড়াছড়ি জেলায় গত ফেব্রুয়ারি মাসে ৮২১ টন টিএসপি, ২০২ টন এমওপি, ৩৬৭ টন ডিএপি এবং ১৫৪৭ টন ইউরিয়া সার বরাদ্দ দেওয়া হয়। আর চলতি মাসে ৫৭০ টন টিএসপি, ১৮০ টন এমওপি, ৩০৩ টন ডিএপি এবং ১১৩৮ টন ইউরিয়া সার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

সরকার নির্ধারিত প্রতি ব্যাগ টিএসপি সারের খুচরা মূল্য এক হাজার ১০০ টাকা অর্থাৎ কেজি প্রতি ২২ টাকা, এমওপি কেজি প্রতি ১৫ টাকা, ডিএপি ও ইউরিয়া কেজি প্রতি ১৬ টাকা।

খাগড়াছড়ির হাট-বাজারগুলো ঘুরে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। সেখানে ২২ টাকার টিএসপি সার বাজারভেদে ৩২-৪০ টাকায়, ১৫ টাকার এমওপি সার ১৭-২২ টাকায় এবং ডিএপি ও ইউরিয়া সার ১৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

জেলার মাটিরাঙার গোমতি ইউনিয়নের রংমিয়া পাড়া এলাকার কৃষক নজরুল ইসলাম। তিনি দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, ‘শান্তিপুর বাজারে এমওপি সার কেজিপ্রতি ২২ টাকা এবং বেলছড়ি বাজারে ২০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। এ দুই বাজারে টিএসপি সার ৩২-৩৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।’

জেলা সদরের কমলছড়ি এলাকার কৃষক সুমিত্র লাল চাকমা বলেন, ‘কমলছড়ির সার ডিলারের কাছ থেকে ইউরিয়া ও এমওপি কেজি প্রতি ১৭ টাকা, ডিএপি ১৮ টাকা ও টিএসপি সার ৩৬ টাকা কেজি দরে কিনেছি।’ একই ভাষ্য কমলছড়ির কৃষক কালাইয়া চাকমা ও বিনয় শান্তি চাকমারও।

লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা সদরের মেজালপাড়া এলাকার কৃষক আবদুস সাত্তার বলেন, ‘সরকার প্রতিটি সারের বিক্রিমূল্য নির্ধারণ করে দিলেও ব্যবসায়ীরা তা মানছেন না। প্রতিটি সারেই অনেক বেশি দাম নিচ্ছেন তারা। এসব অনিয়ম রোধে প্রশাসনের কোনো পদক্ষেপও নেই।’

মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে সারের সংকটকেই চিহ্নিত করছেন খাগড়াছড়ি জেলা শহরের বড়ুয়া ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী প্রিয়দর্শী বড়ুয়া ও ভাই ভাই স্টোরের ব্যবস্থাপক সনাক চাকমা। তবে কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন ভিন্ন কথা।

খাগড়াছড়ি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. সফি উদ্দিন বলেন, ‘কোথাও কোথাও সংকটের অজুহাতে বেশি দামে সার বিক্রির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অথচ এখন সারের কোনো ঘাটতি নেই। প্রকৃতপক্ষে যদি সংকট থাকে তবুও উচ্চদরে বিক্রির কোনো সুযোগ নেই। এটি শাস্তিযোগ্য এবং গুরুতর অপরাধ।’

বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের সভাপতি কেএম ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আমাদের কোনো সদস্য সরকার নির্ধারিত দামের বেশি দরে সার বিক্রির কথা নয়। তবে অনুমোদনহীন কিছু ব্যবসায়ী জেলার বাইরে থেকে সার সংগ্রহ করে বেশি দামে বিক্রি করে থাকে। এটি তাদের দায়।’

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর খাগড়াছড়ি জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক পাপিয়া সুলতানা লিজা বলেন, ‘সার বিক্রির কিছু কিছু অভিযোগ শুনতে পাচ্ছি। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আমরা যে কোনো সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করব।’

খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘কৃষকদের প্রতি সর্বোচ্চ সহনশীলতা রয়েছে আমাদের। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সারে বিশাল অংকের ভর্তুকিও দিচ্ছে সরকার। এখানে কারো কোনো রকমের অনিয়ম ছাড় দেয়া হবে না। যদিও এখন অব্দি আমার কাছে এ বিষয়ে লিখিত কোনো অভিযোগ আসেনি। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’