logo
আপডেট : ৪ মার্চ, ২০২২ ১০:৫৩
পাচার সিন্ডিকেটের শিকার অর্ধশতাধিক নারী
এমদাদুল হক খান

পাচার সিন্ডিকেটের শিকার অর্ধশতাধিক নারী

প্রতীকী ছবি

রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের হাসি বেগম। মা ও দুই বছরের শিশু সন্তানকে নিয়ে তার সংসার। স্বামী মাদকাসক্ত হওয়ায় তার সঙ্গেও যোগাযোগ বন্ধ। ভালো নাচতে জানেন। বিয়েবাড়িতে, গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে নাচ করে যা আয় হয়, তা দিয়ে কোনোমতে চলছিল সংসার। গায়েহলুদের একটি অনুষ্ঠানে নাচতে গিয়ে পরিচয় সাগর নামের এক যুবকের সঙ্গে। এরপর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। মাঝেমধ্যে কিছু টাকা দিয়ে সহায়তা করে সাগর।

একসময় প্রস্তাব দেয় প্রতিবেশী দেশ ভারতের ড্যান্স ক্লাবে নাচলে অনেক টাকা আয় করতে পারবে। তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে ভাগ্য বদলাতে ভারতে যায় হাসি। এরপর থেকেই নিখোঁজ সে। গত আড়াই বছর আর কোনো খোঁজ পায়নি হাসির মা। হাসির শিশুসন্তানকে নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করে চলছে তার মায়ের জীবন। সাগরের কাছে মেয়ের খোঁজ জানতে চাইলে বলত, সে ভালো আছে। সময় হলে যোগাযোগ করবে। কিন্তু এখন মেয়ের খোঁজ জানতে চাইলে নানা রকম হুমকি দিচ্ছে সাগর ও তার সহযোগীরা।

আপন

শুধু হাসি নয়, এ রকম আরো অর্ধ শতাধিক নারীকে ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এই চক্রটি পাচার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকা ঘিরে এ চক্রের গড়ে উঠেছে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক।

চক্রের সদস্যদের টার্গেট অস্বচ্ছল ও ডিভোর্সি বা বিধবা নারী। তাদের উন্নত জীবনযাপনের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এ চক্রের সদস্যরা একাধিকবার গ্রেপ্তার হলেও জামিনে বেরিয়ে পুনরায় একই অপরাধ করে যাচ্ছে।

এদিকে পাচারকারীদের কবল থেকে রক্ষা পেলেও দেশে ফিরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন না নারীরা। প্রতিবেশীসহ স্বজনরা তাদের নানাভাবে তিরস্কার করতে থাকেন। ফলে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেছে নেন। এছাড়া এইডসসহ নানা রোগে ভোগেন এসব নারী। একসময় নিভে যায় তার জীবনপ্রদীপ।

সরেজমিনে কামরাঙ্গীরচরে কথা হয় ভারতে পাচারের শিকার হাসির মায়ের সঙ্গে। তিনি জানান, হাসির স্বামী ছিল মাদকাসক্ত। প্রায়ই তাকে নেশার টাকার জন্য নির্যাতন করত। একসময় নির্যাতন সইতে না পেরে স্বামীকে ডিভোর্স দেন হাসি। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে মায়ের সংসারে বসবাস করতে থাকেন। ভালো নাচতে জানতেন। তাই বিয়ে বাড়িসহ বিভিন্ন স্টেজ শো করে যা আয় হতো তা দিয়ে ভালোই চলছিল সংসার।

ডায়মন্ড

একটি নাচের অনুষ্ঠানে গিয়ে পরিচয় সাগর নামে এক যুবকের সঙ্গে। পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। একদিন সাগর প্রস্তাব দেয় প্রতিবেশী দেশের ড্যান্সবারে নাচলে অনেক টাকা আয় করা সম্ভব। বছর ঘুরলেই অভাব-অনটন দূর হয়ে যাবে। বিষয়টি মাকে জানালে তিনি বাধা দেন। একসময় সংসারের সচ্ছলতা ফেরাতে কোলের শিশুকে রেখে মায়ের অবাধ্য হয়েই সাগরের হাত ধরে ভারতে যান হাসি বেগম। এরপর আর তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

হাসির রেখে যাওয়া শিশু সন্তানের বয়স এখন সাড়ে ৪ বছর। সারাক্ষণ মাকে খুঁজে বেড়ায় ছোট্ট এ শিশুটি। কিন্তু জানে না, কী নির্মমতায় কাটছে তার মায়ের জীবন। হাসির মায়ের অভিযোগ, মেয়ের খোঁজে নারী পাচারকারী সাগরের বাসায় গিয়ে হুমকি-ধমকি খাচ্ছেন তিনি।

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত পাচারকারী সাগরের সঙ্গে কথা হলে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তবে হাসিকে পাচারের কথা জানত বলে স্বীকার করেন তিনি। এছাড়া সাংবাদিকদের সঙ্গে এসব বিষয়ে তার কথা বলতে বড় ভাইদের নিষেধ আছে বলে জানান সাগর। নিজেকে পাঠাও বাইক চালক দাবি করলেও পরিচিত কয়েক জনের কাছে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক মেয়ের খোঁজ করছে বলে জানালেন সাগরের পরিচিত এক যুবক।

কীভাবে পাচারের উদ্দেশ্যে নারী সংগ্রহ করা হয়। এরপর কীভাবে পাঠানো হয়ে তাদের মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে এমন গল্প শোনায় সাগরের এক সময়ের সহযোগী মুসা। চারজন নারীকে পাচারের কথা স্বীকার করে মুসা এ প্রতিবেদককে জানান, লোভে পড়ে তিনি এ চক্রের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন। এরপর র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হলে নিজের ভুল বুঝতে পারেন মুসা। বতর্মানে একটি পানের দোকান চালান তিনি। মুসা বলেন, আমি বুঝতে পেরেছি, মানুষ খুনের চেয়েও বড় অপরাধ নারী পাচার করা। তাই আমি এ কাজ ছেড়ে দিয়েছি।

তিনি বলেন, কামরাঙ্গীরচর এলাকা ঘিরে একটি শক্তিশালী নারী পাচারকারী চক্র গড়ে উঠেছে। চক্রের নেতৃত্ব দেন মামুন ও মুন্না। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেন, আপন, সাগর, ডায়মন্ডসহ বেশ কয়েকজন। চক্রের সদস্যরা অসচ্ছল নারীদের টার্গেট করে। এরপর তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব বা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে নানা প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাচার করা হয়। একজন নারী পাচার করতে পারলে তারা ১০-১৫ হাজার টাকা পান বলে জানান মুসা। এ চক্রের মাধ্যমে প্রায় অর্ধশতাধিক নারী পাচার হয়েছেন বলে মুসা দাবি করেন।

ইমরান

মুসা আরো বলেন, পাচারের শিকার মেয়েরা স্বেচ্ছায় বিদেশ যান। তার ফ্যামিলিও বিষয়টি জানেন। কেউ বিদেশ যেতে চাইলে কোনো টাকা খরচ করতে হয় না। রাজি হলেই চক্রের সদস্যরা ওই নারীর পাসপোর্টসহ সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করে দেন। এছাড়া ওই নারীর পরিবারের সদস্যদের বিদেশ যাওয়ার আগেই এককালীন ৫০-৬০ হাজার দেওয়া হয়। যার যোগান দেন নিয়োগকারী কোম্পানি।

পাসপোর্ট ভিসা হওয়ার পর তাদেরকে নৃত্যশিল্পী হিসেবে বিদেশে পাঠানো হয়। এ সময় ইমিগ্রেশনে দায়িত্বরতদের সঙ্গেও মোটা অঙ্কেও টাকার চুক্তি করা থাকে। তাই তাদের পাচার করতে কোনো বেগ পেতে হয় না। ড্যান্স বারে নাচার কথা বলে নেয়া হলেও তাদের দিয়ে দেহ ব্যবসা করানো হয় বলে দাবি করেন মুসা।

মুসার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পাচারকারী মুন্নার ড্যান্স ক্লাবে গিয়ে দেখা যায় ক্লাবটি বন্ধ। প্রতিবেশীরা জানালেন, রাত আটটায় প্রতিদিন ক্লাবে আসেন মুন্না। তবে ওই দিন তিনি আসেননি। মোবাইল ফোনে কথা হলে মুন্না জানান, তিনি সাভারে একটা প্রোগ্রামে আছেন। তার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ মিথ্যা।

মামুন

মুন্না সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় পাচারের শিকার শারমিন নামে এক নারী লোমহর্ষক বর্ণনা দেন। কামরাঙ্গীরচরের একটি বাসায় কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ড্যান্স বারে নাচার কথা বলে তাকে মালয়েশিয়ায় পাঠালেও সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন ভিন্ন চিত্র। এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার পর তাদের নেয়া হয় নির্জন এলাকার একটি বাসায়।

সেখানে তার সঙ্গে আরো বেশ কয়েক জন মেয়েকে দেখতে পান। রাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ওপর চালানো হয় যৌন নির্যাতন। কেউ বাধা দিলেই নেমে আসে নির্যাতনের খড়্গ। দিনের পর দিন না খাইয়ে রাখা হয়। একপর্যায়ে বাঁচার তাগিয়ে সব কিছু মেনে নিতে বাধ্য হয় অসহায় মেয়েটি।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার সাইদুর রহমান বলেন, ড্যান্স বারের আড়ালে নারী পাচারকারী বেশ কয়েকটি চক্রের সন্ধান তারা পেয়েছেন। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। এছাড়া ইতোপূর্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারকৃতরা জামিনে বেরিয়ে পূর্বের পেশাতেই ফিরে যাচ্ছে। তাদেরকেও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তিনি লোভের বশবর্তী হয়ে কোনো কিছু যাচাই-বাছাই না করে বিদেশ না যাওয়ার অনুরোধ জানান।

সাগর

মানববাধিকার সংগঠন জাস্টিজ কেয়ারের কান্ট্রি ম্যানেজার সিরাজুজ্জামান বেলাল বলেন, পাচারকারীর হাত রক্ষা পেলেও দেশে ফিরে সমাজ বা পরিবারের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পায় না নির্যাতিতারা। বরং সমাজ তাদের থেকে মুখ ফিরেয়ে নেয়। কোনো কোনো নারী আবার দেহে করে নিয়ে আসে মরণঘাতী ভাইরাস এইডস। একসময় নিভে যায় তার জীবনপ্রদীপ। তাই পাচারকারীর হাত থেকে উদ্ধার হওয়া নারীদের সমাজ ও পরিবারের পাশে দাঁড়ানো বলে মনে করেন এই মানবাধিকারকর্মী।