একটা সিনেমায় বিভিন্ন চরিত্র থাকে। ভালো চরিত্র, আবার খারাপ। দরকার হয় পাশ্বচরিত্রের। এমন সংমিশ্রণ একজনের মধ্যে পাওয়া কঠিন। তবে ব্যক্তিটি যদি হন ওয়ার্ন, তাহলে অন্য কিছুর দরকার নাই। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তী লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্ন ছিলেন উভয় চরিত্রের সংমিশ্রণ। মাঠের বাইরে এক জীবন, আর মাঠের বাইরে বিভিন্ন সময়ে তাকে ভিন্ন চরিত্রে দেখা গেছে। এক সময় প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের ঘুম কেড়ে নেওয়া ওয়ার্ন লম্বা একটা সময় আলোচনায় ছিলেন না। অনেকটা নীরব ছিলেন। আর শুক্রবার রাতে একেবারেই নীরব হয়ে গেলেন। এক সময় প্রতিনিয়ত সংবাদের শিরোনাম হওয়া ওয়ার্ন আর কখনো শিরোনামে আসবেন না। কেননা এখন যে তিনি আর পৃথিবীর কেউ নন। পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে, তাও আবার মাত্র ৫২ বছর বয়সে।
মেলবোর্নের বাইরের এক শহর থেকে উঠে আসা একটা ছেলে যে ক্রীড়াঙ্গনের নায়কের আসনে বসে যাবেন বা জাতীয় তারকা হবেন তা সে সময়ে কেউ ভাবতে পারেনি। অথচ অনেকটা একা হাতেই ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন বোলিং লেগ স্পিনকে টেনে তুলেছেন। এমন নায়কের মুদ্রার ভিন্ন পাশে ছিল স্ক্যান্ডাল। এই বিষয়টাকে তাকে নিয়মিত অনুসরণ করে গেছে। কি ছিল না তার স্ক্যান্ডালের তালিকায়। অবৈধ বুকমেকারদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়া, নিষিদ্ধ ড্রাগ ব্যবহার করা থেকে নারী বিষয়ক স্ক্যান্ডালও বাদ যায়নি। আবার ইচ্ছা থাকলেও যে এসব নিষিদ্ধ স্থান থেকে নিজেকে বিশুদ্ধ করা যায় তার প্রমাণও রেখেছেন। হয়েছেন বিখ্যাত ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার।
ক্রিকেটের কিংবদন্তী হলেও একটা সময় ফুটবলের সঙ্গে ছিল তার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। সেন্ট কিলডা ফুটবল ক্লাবের হয়ে অনুর্ধ্ব-১৯ দলে খেলতেন। একই সঙ্গে ক্রিকেটটাও। তবে একবার ফুটবল দল থেকে বাদ পড়ার পর আর সেদিকে যাননি, ক্রিকেটেই মনোযোগী হন। ২১ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণীর এবং ২২ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় ওয়ার্নের। সে সময়ে লেগ স্পিন বোলিং ছিল অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ। বলে অতিরিক্ত স্পিন করাতে হতো। যার ফলে ভুল করার আশঙ্কা থাকতো, একই সঙ্গে মার হজমেরও।
ক্যারিয়ারের প্রথম চার ইনিংসে ৩৩৫ রানে মাত্র ১ উইকেট নিয়ে তার ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। এমনই শঙ্কার মুখেই পেয়ে যান ঘুরে দাঁড়ানোর পথ। পরের ইনিংসেই অসাধারণ বোলিং করেন। সে ম্যাচে শ্রীলঙ্কার জয়ের জন্য দরকার ছিল মাত্র ১৮১ রান। সে পথেই এগুচ্ছিল তারা। কিন্তু ওয়ার্নের চমকে শ্রীলঙ্কার জয়ের স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে গিয়েছিল। ওয়ার্নের বোলিং ফিগারটা ছিল ৫.১-৩-১১-৩।
ক্রিকেটের বল অব দ্য সেঞ্চুরির মালিকও শেন ওয়ার্ন। ইংল্যান্ডের মাটিতে এমন কীর্তি গড়েছিলেন যা ক্রিকেট বিশ্ব সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করে থাকে। মাইক গ্যাটিং সামনে। স্পিন বোলিংয়ের ওঝা নামের খ্যাত গ্যাটিং বলের অপেক্ষায়। বল পড়লো লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে। এরপরই ওয়ার্নের ছোঁড়া বিষ তার কার্যকারিতা প্রমাণ করলো। বল আঘাত হানলো অফ স্ট্যাম্পে। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে গ্যাটিং। চোখেমুখে রাজ্যের অবিশ্বাস। আর দর্শকদের মুখ হা। এমন বলও হতে পারে! বল এতটা বাঁক নিতে পারে!
ওয়ার্নের বোলিংয়ের মূল ছিল নিখুঁত। প্রতি ওভারে একটা বা দুটো বাজে বল হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু ওয়ার্ন নিখুঁত বোলিংয়ের কাজটা ওভারের পর ওভার করে যেতে পারতেন। হয়তো ঘন্টায় একটা বা দুটো বাজে বল হতো তার।
মাঠে বলকে নিজের ইচ্ছামতো ঘোরাতেন ওয়ার্ন। তবে মাঠের বাইরে ওয়ার্ন ঘুরতেন অন্যের হাতে। আর তার নিয়ন্ত্রক যে ভালো ছিল না তার প্রমাণ রয়েছে ভুড়ি ভুড়ি। তাইতো ওয়ার্নের জীবন নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। এতসব করেও দলে তার জায়গা ছিল পাকাপোক্ত। সে সময়কার অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ’র ভাষায় ‘ও তো ওয়ার্ন’।
মাঠে একের পর এক সাফল্যের নায়ক তিনি। একের পর এক দলকে সাফল্য এনে দিয়েছেন। সেই ওয়ার্ন এখন নেই। হয়তো একজন লেগ স্পিনার আবার আমরা পাব। কিন্তু ওয়ার্নের মত এমন চরিত্র হয়তো আর আসবে না।