ছোট শিশু মাহিনের বুকে বাসা বাঁধে মরণঘাতী হৃদরোগ। সেই শিশুকে বুকে নিয়ে ঝিনাইদহ শিশু হাসপাতালে দিন কাটছে মা সুমনা খাতুনের। সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্মের পর থেকেই শ্বাসকষ্টসহ ছিল শিশুটির অন্যান্য শারীরিক সমস্যা। শিশু হাসপাতাল থেকে জন্মের পর তিন মাস বয়সে শিশুটির হৃদযন্ত্রে কয়েকটি ছিদ্র ধরা পড়ে বলে জানান মা সুমনা খাতুন। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় এটি ভালো হতে পারে বলে আশ্বস্ত করেছেন চিকিৎসকরা।
ঝিনাইদহে সিজারিয়ান সন্তান প্রসবের সংখ্যা বাড়ার কারণে দীর্ঘ হচ্ছে শিশুদের শারীরিক নানা সমস্যা। আর মায়েদেরও কাটা স্থানে ইনফেকশনসহ শারীরিক সক্ষমতা কমে আসে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তবে নরমাল ডেলিভারিতে সন্তান প্রসবে এ সমস্যা একেবারেই কম বলে জানান তারা। জেলার বেসরকারি হাসপাতালে সিজারের প্রবণতা বৃদ্ধি পেলেও বিপরীত চিত্র সরকারি হাসপাতালে।
জেলা ইপিআই সেন্টার থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০২১ থেকে ২০২২ সালের বর্তমান সময় পর্যন্ত জেলায় ৪১ হাজার ৭০০ শিশুর জন্ম হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যে সদর হাসপাতালসহ ছয়টি সরকারি হাসপাতালে চার হাজার ৫১৪ শিশুর জন্ম হয়েছে। এর মধ্যে সিজারিয়ানের মাধ্যমে এক হাজার ২০০ এবং নরমালে তিন হাজার ৩১৪টি শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছে।
এদিকে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের তথ্যে তাদের আওতাধীন সেবাকেন্দ্রে ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৫৬৫ শিশু নরমালে ভূমিষ্ঠ হয়েছে।
তবে সদর হাসপাতাল ও শিশু হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, এখানে প্রতিদিন বহির্বিভাগ ও ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়া মোট শিশু রোগীর মধ্যে শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগই সিজারিয়ান নানা জটিলতায় আক্রান্ত। সাধারণত মাতৃগর্ভে ৩৭ থেকে ৪২ সপ্তাহ সময়কে শিশু জন্মের জন্য সঠিক বিবেচনা করা হয়।
শহরের আল ফালাহ হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতাল, শামীমা ক্লিনিক, রাবেয়া হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের হার শতকরা ৯৭ ভাগ। তবে ভিন্ন চিত্র সরকারি হাসপাতালগুলোতে। এখানে সিজারের পরিবর্তে নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে সন্তান প্রসবের প্রবণতা বেশি।
এভাবে সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে যে শিশু ভূমিষ্ঠ হয় তাদের সাধারণত অপ্রাপ্ত বয়সের কারণে ওজন কম হয়। আর সেখান থেকে হার্টের সমস্যা, অপুষ্ট ফুসফুসের কারণে শাসকষ্টজনিত রোগ দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে, গ্লুকোজ লেভেল কমে যাওয়ার কারণে খিচুনিও হতে পারে। এমনকি জন্মের সময় মাথায় আঘাত লাগলে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিবন্ধী হওয়ারও সমস্যা থেকে যায়। আর নরমাল ডেলিভারিতে এ ধরনের সমস্যা একেবারেই কম।
তবে অভিযোগ রয়েছে, কিছু অসাধু ক্লিনিক মালিক ও চিকিৎসক তাদের কাছে গর্ভবতী মায়েরা সেবা নিতে গেলেই সিজারের প্রতি উৎসাহিত করেন। অবশ্য তা অস্বীকার করেন বেসরকারি ক্লিনিকের মালিকরা।
সিজারে বাচ্চা ডেলিভারির অভিজ্ঞতা
জেলার গাড়াবাড়িয়া গ্রামের বিথি বেগম বলেন, ‘গর্ভে সন্তানের বয়স আট মাস হলে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। তখন তারা সনো (আল্ট্রাসনোগ্রাফি) করে বল্লো সিজার করাতে হবে। এরপর আমি সন্তানের ক্ষতি হবে ভেবে সিজার করাই। জন্ম হয় দুটি সন্তানের। কিন্তু জন্মের পর থেকেই তারা কিছু খেত না। জোর করে খাওয়ালেই বমি করে বের করে দিত, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতো। ওজনও ছিল কম। পাঁচদিন পরে বাড়িতে নিয়ে গেলে সমস্যা আরো বাড়ে। এরপর শিশু হাসপাতালে আনলে কিছুটা শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়।’
‘বাড়িতে নিয়ে গেলে আবারো অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে কয়েকদিনের ব্যবধানে আবারো হাসপাতালে ভর্তি করি। এভাবেই অসুস্থতার ওপরে তারা বেঁচে আছে’, বলেন বিথি বেগম।
শহরের আল ফালাহ হাসপাতালে শিশুকে নিয়ে ভর্তি হাসনু বেগম বলেন, সিজারের নয়দিন পর থেকেই আমার বাচ্চার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তারপরই হাসপাতালে এনে ভর্তি করি। এখন স্যালাইন চলছে।
রিমা খাতুন নামে এক নারী বলেন, ‘প্রায় তিন মাস আগে গর্ভবতী অবস্থায় শামীমা ক্লিনিকে গিয়েছিলাম। সে সময় ডাক্তার দেখে বলে দ্রুত সিজার করতে হবে। সেই সিজারের পর থেকেই আমার সন্তানের ওজন কম ছিল, সঙ্গে ছিল শ্বাসকষ্টও। এখন মাঝে মধ্যেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয় আর তখনই ডাক্তারের কাছে নিতে হয়।’
আবাইপুর গ্রামের মাজেদুল ইসলাম জানান, প্রায় পাঁচ বছর আগে সিজারের মাধ্যমে আমাদের ঘরে একটি কন্যা সন্তান এসেছিল। জন্মের সময় অপুষ্ট ছিল। এখনো শারীরিক অসুস্থতা লেগেই থাকে।
বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের গৃহবধূ রেক্সোনা বেগম বলেন, ‘সিজারের মাধ্যমে দুটি সন্তান হয়েছে। এখন তেমন কাজ করতে পারি না। হালকা কাজ করলেই কোমর ও পেটে ব্যথা করে।’
সদর হাসপাতালের গাইনি বিভাগে ভর্তি এক নারী বলেন, সিজারে সন্তান জন্মের পর এখন ইনফেকশন হয়ে গেছে। খালি ব্যথা করে, প্রায়ই অসুস্থ থাকি।
শৈলকুপা উপজেলার বড় বাড়ি বগুড়া গ্রামের রিংকি খাতুন বলেন, ‘সাত মাস সাত দিনে আমার বাচ্চা হয়েছে। এরপর থেকেই ওর শরীরের জন্ডিজ ধরা পড়েছে, সঙ্গে ঠান্ডার সমস্যা রয়েছে।’
নরমাল ডেলিভারিতে সুস্থ আছে মা-সন্তান
যুগনী গ্রামের গৃহবধূ সুখিরন বেগম বলেন, ‘বয়স ৫০ পার হয়েছে। নরমালে পাঁচটি সন্তানের জন্ম হয়েছে, আজও আমি শারীকিভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। কাজ করতে কোনো সমস্যা হয় না।’
হরিনাকুণ্ডু উপজেলার চুলকানি বাজার সংলগ্ন এলাকার গৃহবধূ রিয়া খাতুন বলেন, ‘নরমালে পাঁচ বছরের ব্যবধানে দুটি সন্তানের জন্ম দিয়েছি। এখনো সন্তান আর আমি সুস্থ আছি। কোনো শারীরিক সমস্যা হয় না।’
ক্লিনিকের মালিক চিকিৎসক হলে সিজার ‘বেশি’ হয়
সিজারে উৎসাহিত করার অভিযোগ অস্বীকার করে বেসরকারি রাবেয়া হাসপাতালের মালিক সোহেল রানা বলেন, ‘কাউকেই সিজারে উৎসাহিত করি না। সিজারের থেকে নরমাল ডেলিভারিতে আমাদের লাভ বেশি। তবে যেসব ক্লিনিকের মালিক চিকিৎসক, বিশেষ করে গাইনি চিকিৎসক তাদের ক্লিনিকে সব থেকে বেশি সিজার হয়। সেখানে নরমাল ডেলিভারি হয় না বললেই চলে।’
তবে শহরের শামীমা ক্লিনিকের মালিক অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. শামীমা সুলতানা বলেন, আসলে রোগীর স্বজনরা দেরি করতে চায় না, নারীরা প্রসব ব্যথা সইতে চায় না। ফলে তাদের ইচ্ছাকে অনেক সময় প্রাধান্য দিতে সিজার করতে হয়।
সিজারে যত সমস্যা
ঝিনাইদহ বিশেষায়িত ২৫ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি শিশু হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আলি হাসান ফরিদ জামিল বলেন, ‘সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে বাচ্চার জন্ম হলে তাদের ওজন কম থাকতে পারে। এ থেকে শিশুর হৃদরোগ হতে পারে। একই সঙ্গে ফুসফুস ছোট হওয়ার কারণে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা হতে পারে যেটাকে আরডিএস বলা হয়ে থাকে।
‘বাচ্চার যদি গ্লুকোজ লেভেল কমে যায় তাহলে খিচুনি হতে পারে। যেসব শিশু নির্দিষ্ট সময়ের আগে ভূমিষ্ঠ হয় তাদের জন্ডিসের সমস্যা বেশি হয়। সিজারের সময় কোনো কারণে যদি বাচ্চার মাথায় আঘাত লাগে তাহলে পেরিনেটাল অ্যাসপেকশিয়া হতে পারে, যেখান থেকে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিবন্ধী হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। কিন্তু নরমাল ডেলিভারিতে বাচ্চার জন্ম হলে এই সমস্যাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে না।’
এই শিশু বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, যদিও কোনো অদক্ষ দাইয়ের মাধ্যমে নরমাল ডেলিভারি করালে এসব সমস্যার শঙ্কা থেকেই যায়। গ্রামাঞ্চলে এ সমস্যাগুলো বেশি থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাচ্চা অবস্ট্রাকটেড লেবার হয়ে গেলে জোর করে টেনে হিঁচড়ে বাচ্চা ভূমিষ্ঠ করার চেষ্টা করা হয়।
এমন জটিলতা থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হলে বাচ্চা পেটে আসার পর থেকেই নিয়মিত চেকআপ ও প্রয়োজনীয় কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হবে। কোনো ধরনের সমস্যা হলেই যেখানে সেখানে না গিয়ে সরাসরি সরকারি হাসপাতালে আসতে হবে। সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্স দিয়ে সেবা নেওয়ার পাশাপাশি ডেলিভারি করাতে হবে।
সরকারি চিকিৎসকরা চান নরমাল ডেলিভারি
ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের সিনিয়র গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. আলাউদ্দিন বলেন, ‘আমার সব সময়ই চাই নরমাল ডেলিভারি করাতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও নির্দেশনা রয়েছে ১০ থেকে ১৫ ভাগ নারীর সিজারের প্রয়োজন হয়। তবে নরমাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে অনেক সময় নারীর ভিভিএফ ডেভেলপ করতে পারে।
‘সিজারের ফলে নারীদের ইনফেকশনের হার অনেক বেড়ে যায়, আনহেলদি কন্ডিশনে সিজার হলে ইনফেকশন হয়ে পিপিএইচ হতে পারে। অনেক সময় কাটা স্থানে সেলাই খুলে গিয়ে ইনফেকশনাল হর্নিয়া ডেভেলপ করতে পারে। সবার ক্ষেত্রের সমস্যা এক না হলেও অনেক নারীরই কর্মক্ষমতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি অনেক সমস্যা সারা জীবনই থেকে যায়।’
এই গাইনি বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, ‘মা ও শিশুর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে অবশ্যই নরমাল ডেলিভারির হার বাড়াতে হবে। গ্রাম থেকে শুরু করে শহরাঞ্চলেও সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে। এছাড়া যত্রতত্র যে ক্লিনিকগুলো গড়ে ওঠছে আর সেখানে সিজার হচ্ছে এগুলো বন্ধে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে অভিযান পরিচালনা করতে হবে, এগুলো বন্ধ করতে হবে। কেননা কোনোভাবেই মা বা সন্তানকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলা যাবে না।’
ঝিনাইদহ সিভিল সার্জন ডা. শুভ্রা রানী দেবনাথ বলেন, ‘যত্রতত্র অপ্রয়োজনে সিজার করা বন্ধে স্বাস্থ্য বিভাগ নিয়মিতই ক্লিনিকগুলোতে অভিযান চালাচ্ছে।’