কোভিড-১৯-এর প্রকোপ আমাদের জীবন যাত্রা অনেকটাই পালটে গেছে। রোজ সকালে ছুটতে ছুটতে অফিস যাওয়ার চেহারাও বদলে গেছে, বরং অফিসটাই উঠে এসেছে ঘরের মধ্যে। অফিসের অনেক কাজই এখনো ঘরে বসেই হচ্ছে। ঘরে সময়মতো ল্যাপটপ খুলে বসে পড়লেই হল! সারাদিনের যাবতীয় কাজ থেকে শুরু করে অফিসের মিটিং, ওয়েব কনফারেন্স, সবই চলছে বাড়িতে বসেই।
সমস্যা হল, বাড়ির বাইরে বেরোতে হচ্ছে না বলে অনেকেই মুডটাও ঠিক অফিশিয়াল করে উঠতে পারছেন না, বাড়ির পোশাকেই অফিসের কাজ করছেন, এমনকী যেমন তেমনভাবে বসে পড়ছেন ভিডিও মিটিংয়ে। বাড়ির পাজামায় ভিডিও মিটিংয়ে বসা যেমন পেশাদারিত্বের পরিচয় নয়, তেমনি খেয়াল রাখতে হবে ম্যানার্সের দিকেও।
নিশ্চয়ই ভাবছেন, বাড়িতে বসে কাজ হচ্ছে যখন, এত তাড়াহুড়ো করে কি লাভ, কিংবা অফিশিয়াল পোশাকেরই বা কি দরকার। এমনিতে বাড়ির পোশাকে অফিসের কাজ করলে তেমন ক্ষতি নেই, কিন্তু ভিডিও মিটিংয়ের সময় বাড়তি সতর্ক আপনাকে হতেই হবে। বাড়ির রংচটা জামা বা ম্যাক্সি যত আরামদায়কই হোক, ভিডিও মিটিংয়ের সময়টায় অন্তত অফিশিয়াল ম্যানার্সের দিকে নজর দিন।
সালোয়ার কুর্তি, স্কার্ট-টপ পরে বসতে পারেন। মোটামুটি আপনি যে ধরনের পোশাকে অফিস যান, সেই ধারাটা ধরে রাখলেই যথেষ্ট। অফিসের ভিডিও মিটিংয়ে বসার আগে নিজেকে একটু ফিটফাট করে নিন। মুখে মেকআপ করার দরকার নেই। শুধু চুলটা আঁচড়ে নিন ভালো করে। মুখে ময়শ্চারাইজার মেখে নিন, হালকা কমপ্যাক্ট বুলিয়ে নিতে পারেন তার উপরে। ঠোঁটে পরুন লিপগ্লস।
এ তো গেল পোশাক আর মেকআপের কথা। এমন জায়গায় বসে ভিডিও মিটিং করুন, যেখানে বাড়ির লোকজন আসবেন না। আগে থেকে তাঁদের বলে দিন। জায়গাটায় যেন যথেষ্ট আলো থাকে। বিশেষ খেয়াল রাখুন ব্যাকগ্রাউন্ডের দিকে। অনেকেরই বাড়িতে জিনিসপত্র এলোমেলো থাকে, অগোছালো হয়ে থাকে। আপনার ব্যাকগ্রাউন্ডটা একটু গুছিয়ে নিতে ভুলবেন না।
অপ্রয়োজনীয় আজেবাজে জিনিস সরিয়ে দিন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে। ভিডিও মিটিংয়ে কানেক্টিভিটির সমস্যা হতে পারে, আরও নানা যান্ত্রিক সমস্যা হতে পারে। একেবারে শেষ মুহূর্তে লগইন করলে সামাল দিতে পারবেন না। মিটিং শুরুর অন্তত আধঘণ্টা আগে লগইন করে অপেক্ষা করুন।
ভিডিও মিটিংয়ে বসে দাঁতে নখ কাটবেন না, গা এলিয়ে বসে থাকবেন না। অফিসে মিটিং থাকলে যেভাবে আচরণ করেন, তেমনই থাকুন। খুব প্রয়োজন না পড়লে চেয়ার ছেড়ে উঠে যাওয়াও ঠিক নয়। মিটিংয়ের মাঝখানে কিছু খাবেন না, দেখতে খুব খারাপ লাগে। কম্পিউটারের ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন ঠিকমতো কাজ করছে কিনা সেটাও আগে থেকে দেখে নিতে হবে।
হাতের কাছে পানির বোতল বা গ্লাস রাখুন। নোটবই আর কলম নিয়ে বসুন। আর হ্যাঁ, মোবাইল ফোন অবশ্যই সাইলেন্ট রাখবেন এ ক্ষেত্রেও। আলোচিত বিষয়গুলিও ডিজিটাল সিটিজেনশিপের কিছু আচরণবিধি।
সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘ডিজিটাল সিটিজিনশিপ’ বিষয়ে একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)’র অর্থায়নে, ডিনেট এবং ফ্রেডরিক নওম্যান ফাউন্ডেশন ফর ফ্রিডম (এফএনএফ বাংলাদেশ) যৌথভাবে ‘Foster Responsible Digital Citizenship to Promote Freedom of Expression in Bangladesh’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে দায়িত্বশীল ডিজিটাল সিটিজেন হতে সহায়তা করা এবং তাঁদের মাঝে গঠনমূলকভাবে স্বাধীন মত প্রকাশের চেতনা গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এই প্রকল্প কাজ করে যাচ্ছে।
প্রাথমিক থেকে শুরু করে শিক্ষাজীবনের যেকোনো পর্যায়েই মানুষ তার করণীয় সম্পর্কে একটা দিকনির্দেশনা পায়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না, তা নিয়ে ওরিয়েন্টেশন থাকে। কিন্তু ডিজিটাল শিক্ষার শুরুতে মানুষের কোনো নির্দেশনা থাকে না। তাই ডিজিটাল লাইফেরও ডিজিটাল রিটারেসি বা ব্যবহারবিধি বা আচরণবিধি প্রয়োজন বলেই মনে করেন এই খাতের বিশেষজ্ঞরা।
তাহলে ডিজিটাল পণ্যগুলোর সঠিক ব্যবহার কিভাবে করতে হবে তাও জানতে পারবে মানুষ। যদিও উন্নত বিশে^র অনেক দেশে পাঠ্যপুস্তকের সিলেবারে অন্তর্ভূক্ত থাকে এই ডিজিটাল সিটিজেনশীপ বিষয়টি। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে এই বিষয়টি সম্পর্কে কোন কারিকুলাম নেই।
এদিকে দেশের তরুণরা শুধু বাংলাদেশের সাইবার স্পেস নয়, সারা বিশ্বের ডিজিটাল স্পেস নিরাপদ রাখতে সাহসী ভূমিকা নিচ্ছে। তরুণরা এখন আর শুধু বিনোদনের জন্য নয়, বরং ইন্টারনেটের শক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে একেকজন ডিজিটাল খাতে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করছে।
তারা পরিবারে সচ্ছলতা আনার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকে ডিজিটাল অর্থনীতি হিসেবে গড়ে তুলছে। তাই তাদের মতামত, পরামর্শ ও সুপারিশগুলো আমাদের কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য শিশুদের অবশ্যই যথাযথ শিক্ষা দিতে হবে। এখান থেকে শিশুরা ভালোর সঙ্গে খারাপটাও শিখছে।
তারা ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডকে আসল জগৎ মনে করে। ফিজিক্যাল ওয়ার্ল্ড তাদের কাছে অনেকটাই অপরিচিত। ইউটিউব দেখে তারা অনলাইনে শিক্ষকদের ভেংচাচ্ছে। অনলাইন কনটেন্টে ৭০ শতাংশই গালাগালিতে পূর্ণ। এটা শিশু-কিশোররা শিখছে। তাই এ সম্পর্কে তাদের করণীয় শেখাতে হবে। যেভাবে বাচ্চাদের গণিত, বিজ্ঞান, ইংরেজি বাধ্যতামূলক শেখানো হয়; তেমন করে ডিজিটাল লিটারেসি সম্পর্কেও বাধ্যতামূলক কোর্সের মাধ্যমে তাদের শেখাতে হবে।
প্রশ্ন আসে, বাচ্চাদের ইন্টারনেট দেয়া ঠিক কি না। তাদের ইন্টারনেটে না আনলে শিখবে কিভাবে? আমরা তাদের শেখাব কিভাবে ইন্টারনেটের জগতে সাইবার বুলিং থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হয়। কিভাবে প্রয়োজনীয় কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয়। এ জন্য তাদের মা-বাবাকে প্রথমে ট্রেনিং দিতে হবে।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চর্চা শুধুই একটি প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি নয়, এটি একটি দক্ষতা। যে দক্ষতা সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে ক্রমেই শিক্ষিত হওয়া ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নিয়মিত চর্চার ফলে অর্জিত হতে পারে।
বর্তমানে একজন আদর্শ নাগরিক হওয়ার অপরিহার্য শর্ত হেলা অনলাইন ও অফলাইনে নিজের নাগরিক অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সঠিক ধারণা ও এর চর্চার দক্ষতা অর্জন করা।
বাংলাদেশের মানুষ সবসমই গণতন্ত্র ও অধিকারের জন্য লড়েছে। আর এর প্রাথমিক চর্চা হলো বিনয়ের সাথে ভিন্নমত শোনা ও সম্মানের সাথে দায়িত্বপূর্ণ মতামত প্রকাশ করা। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও অনলাইনভিত্তিক কর্মকান্ড অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের জন্য ডিজিটাল জগতে বিচরণে প্রযুক্তিগত সতর্কতার পাশাপাশি সামাজিক, আইনগত ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলা জরুরি।
কিন্তু প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির অভাবে শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নানা ধরনের অনাকাঙ্খিত আচরণ করছে বা তার শিকার হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ডিজিটাল সিটিজেনশিপ শিক্ষার তিনটি ভিত্তি:
সম্মান করা ( নিজেকে ও অন্যদের),
শিক্ষিত করা (নিজেকে ও অন্যদের ) এবং
সুরক্ষা দেওয়া (নিজেকে ও অন্যদের ) ব্যবহার করে তাদের শিক্ষিত করা প্রয়োজন।
এই শিক্ষার্থীবান্ধব ওয়েবসাইট থেকে শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল সিটিজেনশিপ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষণীয় বিষয় জানতে পারবেন এবং একটি গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা চর্চার পদ্ধতি সম্পর্কে জানবেন।
যা তাঁদের ডিজিটাল দুনিয়ায় বিচরণের ক্ষেত্রে আচরণগত পরিবর্তন এনে একজন গর্বিত ডিজিটাল নাগরিকে পরিণত হতে সহায়তা করবে।