দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের গুরুত্বপূর্ণ খাত হয়ে উঠতে পারে মেডিকেল ট্যুরিজম- এমনটি মনে করছেন দেশের স্বাস্থ্য সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, চিকিৎসাসেবা গ্রহণের নামে ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে বৈধ ও অবৈধ পথে প্রতি বছর কোটি কোটি অর্থ চলে যাচ্ছে।
অথচ দেশের উন্নত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের সক্ষমতার বিষয়টি আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও প্রশংসিত। দেশে রয়েছে মেডিকেল ট্যুরিজম গড়ে তোলার মতো শক্তিশালী চিকিৎসা অবকাঠামো। চিকিৎসা ব্যয় হ্রাসের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, জবাবদিহিতা ও আস্থার মাত্রা বৃদ্ধি করা গেলে দেশে স্থায়ী ও শক্তিশালী মেডিকেল ট্যুরিজম গড়ে উঠবে বলে আশা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেডিকেল ট্যুরিজম হলো কোনো এক দেশ থেকে অন্য আরেক দেশে সাধ্যের মধ্যে খরচে সুচিকিৎসার আশায় ভ্রমণ করা। যে চিকিৎসা রোগী তার মাতৃভূমিতে চিকিৎসাসেবা পেতে অপারগ তা পাওয়ার জন্য উন্নত দেশে যাওয়ার বিষয়টি মেডিকেল ট্যুরিজমের আওতায় পড়ে।
মেডিকেল ট্যুরিজমের আওতায় কিছু সংস্থা আছে যারা রোগী এবং রোগীর পরিবারকে এক দেশ থেকে অন্য দেশে কম খরচে নিয়ে যাওয়া এবং তাদের থাকা ও চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়ে থাকে। তারা কম খরচে উন্নত মানের চিকিৎসা পেতে রোগী এবং রোগীর পরিবারকে সাহায্য করে।
সাধারণত রোগীকে দেশের বাইরে চিকিৎসা করতে নিয়ে এলে রোগীর পরিবারকে কিছু দিন বিদেশে থাকতে হয়। মেডিকেল ট্যুরিজমের আওতায় থাকা এই সংস্থাগুলো তখন সেই রোগীর পরিবারের সদস্যদের এই বিদেশে ভ্রমণের সুযোগও করে দেয়। আর এই সমস্ত রকমের সুবিধা তারা প্যাকেজের মাধ্যমে রোগীর পরিবারকে দিয়ে থাকে। রোগীর পরিবার প্যাকেজ পছন্দ করে সহনীয় খরচে বিভিন্ন সুবিধা পেতে পারেন।
বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের কারণ
চিকিৎসক সংগঠনের নেতারা জানান, দেশের সর্বত্র প্রাথমিক চিকিৎসা সেবার অবকাঠামো বেশ মজবুত। কিন্তু দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রযুক্তিগত দিক এখনো সর্বজনীনভাবে আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠতে পারেনি। স্বাস্থ্য সেক্টরের অবকাঠামো শক্তিশালী হলেও আন্তর্জাতিক মানের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নেই বললেই চলে।
বিষয়টি সম্পর্কে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আল সাফী মজুমদার ভোরের আকাশকে জানান, তথ্য বিভ্রাটের শিকার হয়ে অনেকে বিদেশে যায়। ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যরা বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ করে আত্মতৃপ্তি পেতেই বিদেশে গিয়ে থাকেন। অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কেউ কেউ দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর আস্থা রাখতে পারেন না। তাদের অনেকে দেশের প্রথম শ্রেণির সব হাসপাতালের খোঁজখবর নেন না। আর অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা বাধ্য হয়েই বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান।
বিদেশে যাওয়ার পেছনে দেশীয় চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রযুক্তিগত দুর্বলতাকে দায়ী করলেন ডক্টর ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদী-ই মাহবুব।
তিনি ভোরের আকাশকে জানান, বাংলাদেশিরা মূলত দুটি কারণে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। এক শ্রেণির মানুষ বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ করে আত্মতৃপ্তি পাওয়ার চেষ্টা করেন। আর দেশে চিকিৎসা গ্রহণের পরও শারীরিক অবস্থার উন্নতি না ঘটলে ওই রোগী বিদেশে যাওয়ার চিন্তা করে থাকেন।
তিনি আরো জানান, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেক্টরের অবকাঠামো অনেক শক্তিশালী। কিন্তু এখনো দেশের সর্বত্র বেশ কিছু জটিল রোগের চিকিৎসার সুযোগসুবিধা নেই। শুধু তাই নয়, কিছু জটিল রোগের চিকিৎসাপদ্ধতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়ে গেছে। শুরু হয়েছে বোনম্যারো প্রতিস্থাপন ও লিভার সংযোজন কার্যক্রম।
প্রাথমিক চিকিৎসা নয়, জটিল রোগের চিকিৎসা করানোর জন্যেই মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাড়ি জমায়। গবেষণায় দেখা গেছে, সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষ চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন দেশে যেয়ে থাকেন। এই সামর্থ্যরে মধ্যে তিনটি উপাদান রয়েছে- আর্থিক সঙ্গতি, লোকবলের সঙ্গতি, যোগাযোগের সঙ্গতি।
বাংলাদেশে মেডিকেল ট্যুরিজমের সম্ভাবনা
ডক্টর ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদী-ই মাহবুব বলেন, বাংলাদেশেও মেডিকেল ট্যুরিজমের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে গড়ে তোলা যাবে, দেশে এমন অনেক হাসপাতাল রয়েছে। শুধু বাড়াতে হবে বিনিয়োগ। দক্ষ জনবলসহ অত্যাধুনিক মানের মেডিকেল উপকরণ থাকতে হবে।
চিকিৎসা সেক্টরের প্রযুক্তিগত দিক আরো শক্তিশালী করার পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসা প্রদানের ওপর জোর দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত, এমপি।
তিনি বলেন, চিকিৎসাসেবার সার্বিক অবস্থার উন্নতি ঘটলে যেকোনো দেশে মেডিকেল ট্যুরিজম গড়ে উঠবেই। বাংলাদেশের অনেক হাসপাতাল ইতোমধ্যে মেডিকেল প্রযুক্তিতে উন্নতি লাভ করেছে। এখন বাড়াতে হবে দক্ষ জনবল। আর স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা থেকে জীবন বাঁচানোর মতো সব ধরনের চিকিৎসাসেবাই বাংলাদেশে রয়েছে বলে মনে করেন সরকারের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা বৈজ্ঞানিক ডা. মুস্তাক হোসেন।
তিনি বলেন, প্রথমে দেশে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার দিকে নজর রাখতে হবে। দেশের চিকিৎসা অবকাঠামো এমনিতেই বিভাগ থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। তারপর জেলা ও বিভাগ পর্যায়ের প্রথম শ্রেণির চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো অত্যাধুনিক করে সাজাতে হবে। সব রোগের উন্নত চিকিৎসাসেবার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
আগের তুলনায় বিদেশগামী রোগীর সংখ্যা অনেক হ্রাস পেয়েছে বলে মনে করেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. আব্দুল্লাহ আল সাফী। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে দেশে অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা পদ্ধতির দ্বার খুলেছে। আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশেও মেডিকেল ট্যুরিজমের ব্যাপক বিস্তার ঘটবে।