ক্রয়-বিক্রয়ে নেই কোনো বৈধতা। এরপরও হরহামেশেই বিক্রি হচ্ছে কোটি কোটি টাকার ল্যাপটপ। এতে করে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। বিক্রেতাদের কাছে শুল্ক ও ভ্যাট-ট্যাক্সের নেই কোনো কাগজপত্র। ক্রেতাদের শুধু ধরিয়ে দেওয়া হয় একটি ম্যানি রিসিট। কিন্তু কেন? এভাবে টাকা দিয়ে যে বিপদ কিনছেন তা হয়তো জানা নেই ক্রেতার।
এদিকে বিক্রেতারা প্রকাশ্যে শুল্ক ও ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে অবৈধ পথে ল্যাপটপ আনার কথা স্বীকার করছেন। কখনো কুরিয়ার আবার কখনো বিমানে বিভিন্ন যাত্রী বেশে আনা হচ্ছে এসব ল্যাপটপ। ঘটছে গ্রেপ্তারের মতো ঘটনাও।
সম্প্রতি, এমনই একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে রাজধানীর উত্তরা আজমপুরে অবস্থিত রাজউক কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স মার্কেট জুড়ে। ওই মার্কেটের কয়েকজন ব্যবসায়ী ও ক্রেতার অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে অনুসন্ধানে নামে ভোরের আকাশের প্রতিবেদক।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, মার্কেটের ষষ্ঠতলায় ‘উত্তরা কম্পিউটার সিটি’ নামে অবৈধ ও চোরাই ল্যাপটপের বৃহৎ বাজার গড়ে উঠেছে। যেখানে ল্যাপটপ বিক্রির আটটি দোকান রয়েছে। প্রতিটি দোকান শতাধিক ল্যাপটপ দিয়ে সুসজ্জিত। এসব দোকান থেকে বিক্রীত শতভাগ ল্যাপটপই অবৈধ ও চোরাই পণ্য।
নাম-পরিচয় গোপন রেখে ক্রেতা সেজে দীর্ঘ সময় কয়েকটি দোকানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ল্যাপটপের দারদাম করি। এ সময় লক্ষ্য করি, তিনটি দোকানে প্রায় পাঁচটি ল্যাপটপ বিক্রি করলেন দোকানিরা। সেখানে ম্যানি রিসিট ছাড়া আর কিছুই দেওয়া হলো না তাদের। এতেই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেল।
সেই ল্যাপটপ ক্রেতার পিছু নিলেন এ প্রতিবেদক। মার্কেটের নিচে এসে কথা হলো তার সঙ্গে। তাকে বলা হলো কত টাকা দিয়ে কিনলেন? জবাবে বলেন, এইচপি ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ কেনেন ৫৫ হাজার টাকায়। কি কি পেপার দেওয়া হলো আপনাকে এমন প্রশ্নে কিছুটা বিব্রত। নাম বলতে চাইলেন না তিনি। শুধু ম্যানি রিসিট দেওয়া হয় সবাইকে। বলে দ্রুত রিকশায় উঠে চলে গেলেন।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য, চোরাই ল্যাপটপ বিক্রির সূত্র ধরে একাধিক বার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছেন তারা। চোরাই ল্যাপটপ বিক্রির দায়ে জেএম টেকনোলজি দোকানের মালিক মিজানকে ২০২০ সালে উত্তরা পূর্ব থানা ও ২০২১ সালে ধানমন্ডি থানা পুলিশ আটক করে।
বিডি ল্যাপটপ দোকানের মালিক রুবেলকে চোরাই ল্যাপটপ বিক্রির দায়ে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে উত্তরা-পশ্চিম থানা পুলিশ আটক করে। পরে মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়। পিসি ওয়ার্ল্ডের মালিক রায়হান টুটুলকে গাজীপুরের কালীগঞ্জ থানা পুলিশের ল্যাপটপ চুরির মামলায় রাজউক মার্কেটে ল্যাপটপসহ গ্রেপ্তার করে কালীগঞ্জ থানা পুলিশ।
সরেজমিন দেখা যায়, তাকে তাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে নামিদামি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ। এমন কোনো ব্র্যান্ড নেই যা এখানে পাওয়া যায় না। এক বার চোখ গেলে ফেরানোর উপায় নেই ক্রেতার। চাকচিক্য ডেকোরেশন যেন মন কেড়ে নেয় ক্রেতার।
রাজউক কমার্শিয়াল মার্কেট ব্যবসায়ী ও ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে জানা যায়, রাজউক মার্কেটের ষষ্ঠতলা থেকে যত ল্যাপটপ বিক্রি হয়, ক্রেতাকে তারা টাকার রসিদ ছাড়া অন্য কোনো কাগজপত্র দিতে পারেন না।
অভিযোগের ভিত্তিতে কম্পিউটার সিটির কয়েকটি দোকান ঘুরে জানা যায়, দোকানে সুসজ্জিতভাবে সাজানা ল্যাপটপের সিংহভাগ দুবাই ও অন্যান্য দেশ থেকে আগত যাত্রীদের ল্যাগেজ ও কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশে আনা হয়। এসব ল্যাপটপ আমদানি এবং ক্রয়-বিক্রয়ে নেই কোনো শুল্ক ও ভ্যাট-ট্যাক্স ও কাগজপত্র।
এ বিষয়ে ল্যাপটপ বিডি নামক দোকানের মালিক রুবেল জানান, পুরো মার্কেটেই এ ধরনের ল্যাপটপ বিক্রি হয়। আমি ঢাকা থেকে নিয়ে আসি, তারা কোথা থেকে নিয়ে আসে তা আমার জানা নেই।
উত্তরা কম্পিউটার সিটি মার্কেটের সবচেয়ে বড় ল্যাপটপ বিক্রির দোকান ‘পিসি ওয়ার্ল্ড’-এর মালিক রহিমা খাতুন জানান, দুবাইয়ে আমাদের লোক আছে। তারা যাত্রীদের ল্যাগেজের মাধ্যমে ল্যাপটপ পাঠান। দেশে আসার পর ওই যাত্রী বিমানবন্দর থেকে বের হলে আমরা ল্যাপটপ নিয়ে নিই। কিছু কিছু সময় কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমেও আনা হয়ে থাকে।’
তিনি আরো বলেন, বাইনারি গ্যাজেট, গ্যাজেট ভ্যালি, ল্যাপি ভ্যালি, এবিসি কম্পিউার টেকসহ মার্কেটের সব দোকানই এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আমি একা এ ব্যবসা করি না।
এ বিষয়ে উত্তরা সিটি কম্পিউটার মার্কেটের মালিক হাবিব মোহাম্মাদ সাইফুল্লাহ বলেন, ল্যাগেজের মাধ্যমে যেসব ল্যাপটপ বিক্রির জন্য আনা হয়, তা অবৈধ। এতে দেশের শুল্ক ও ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া হয়। এ রকম একটি ল্যাপটপ বিক্রির বাজার আমার মার্কেটে গড়ে উঠেছে, জানি না। আমি তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেব।
কম্পিউটার সিটির ম্যানেজার মিন্নত আলী বলেন, আমরা ব্যবসায়ীদের মিটিংয়ে তাদের এ ধরনের ল্যাপটপ বিক্রি যেন না করে বারবার নিষেধ করে আসছি। কিন্তু তারা কর্ণপাত করেন না।
এ বিষয়ে রাজউক মার্কেট ব্যবসায়ী উন্নয়ন কমিটির সভাপতি আওলাদ হোসেন বলেন, তারা আমাদের কথা শুনে না। আপনারা নিউজ করেন, আশা করি প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
বিষয়টি নিয়ে ল্যাপটপ রিপেয়ার বা সার্ভিসিং দোকানে কথা হলে তারা জানান, এসব পণ্যের বৈধ কোনো বাজার না থাকার কারণে সার্ভিসিংয়ে জটিলতা দেখা দেয়। অধিকাংশ সময়ে আমরা পুরাতন পার্টস দিয়ে সার্ভিসিং করে থাকি। তাই একটি ল্যাপটপ একবার নষ্ট হলে বারবার সার্ভিসিং করাতে হয়।
সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ বলছেন, এর আগেও ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে কয়েকবার কয়েকজনকে আটক করেছিলাম। পরে মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়। আবার কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেব।