logo
আপডেট : ৭ মার্চ, ২০২২ ০৮:০০
যেভাবে রক্ষা পেল ৭ মার্চের ভাষণের ভিডিওটেপ
আহমাদ সোহান সিরাজী, সাভার (ঢাকা)

যেভাবে রক্ষা পেল ৭ মার্চের ভাষণের ভিডিওটেপ

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকেই যখন নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ জীবন বাজি রেখে রক্ষা করেছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ফিল্ম ডিভিশনের সহকারী ক্যামেরা পারসন আমজাদ আলী খন্দকার। কালজয়ী সেই ভাষণ যারা রেকর্ড করেছিলেন, তিনি তাদের অন্যতম।

কিন্তু এই ভাষণ রেকর্ড ও সংরক্ষণ মোটেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। এর পেছনে ছিলেন তৎকালীন তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন টেলিভিশনের কয়েকজন অকুতোভয় কর্মী। পাকিস্তান সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেকর্ড করেন ফিল্ম ডিভিশনের আটজন। আর এর নেতৃত্ব দেন ওই বিভাগের প্রধান মুহিবুর রহমান খান। যিনি অভিনেতা আবুল খায়ের নামে বেশি পরিচিত।

ভোরের আকাশকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই স্মৃতিচারণ করে আমজাদ আলী বলেন, ‘আমরা রেসকোর্স ময়দানে যখন যাই, দেখতে পাই ভোর থেকেই লোকজন এসে মাঠ পূর্ণ হয়ে গেছে। এর মধ্যেই আমরা গিয়ে ক্যামেরা বসালাম। ভাষণ রেকর্ড করার দায়িত্বে ছিলাম আমি ও মবিন সাহেব। রউফ সাহেব এবং তৌহিদ ঘুরে ঘুরে শট নেন।

একুশে পদকে ভূষিত আমজাদ আলী খান।

তখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যে ফিল্ম ডেভেলপ করে নিয়ে আসব, সে ব্যবস্থা আমাদের ছিল না। সেটা করতে যেতে হতো এফডিসি ল্যাবে। বঙ্গবন্ধুর নাম দেখলে এটা নষ্ট করে ফেলবে, সেজন্য আমরা কৌশল করে ‘সাইক্লোন’ চিহ্ন দিয়ে এফডিসি থেকে ডেভেলপ করে নিয়ে আসলাম, যাতে অন্যরা মনে করে, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় সংশ্লিষ্ট ফিল্ম এগুলো।

এরপর ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলার পরদিন থেকে বিভিন্ন অফিস-আদালতে দায়িত্ব নিতে শুরু করে পাকিস্তানি হানাদাররা। চলচ্চিত্র বিভাগের মুক্তিকামী কর্মীরা ধারণা করলেন, পাকিস্তানি সেনারা যদি হানা দেয়, তাহলে এসব ধ্বংস করে দেবে। সে কারণে কীভাবে এগুলো সচিবালয়ের আর্কাইভ থেকে সরানো যায় সেই পরিকল্পনা করলেন বিভাগের প্রধান মহিবুর রহমান।

তখন উনি আমাকে বললেন, `আমজাদ তোমাকে একটা দায়িত্ব দেব।'

আমি বলছি, `কী দায়িত্ব স্যার?'

উনি বললেন, `তোমাকে এই মুহূর্তে ফিল্মগুলো নিয়ে ঢাকার বাইরে যেতে হবে।'

এরপর তিনি আমাকে একটি ট্রাঙ্ক কিনে আনার জন্য টাকা দেন। সেই টাকা দিয়ে সদরঘাট থেকে ৪২ ইঞ্চি মাপের ট্রাঙ্ক কিনে আনি। পরে মহিবুর রহমান নিজে ট্রাঙ্কের ভেতর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, কাজী নজরুল ইসলামের ওপর করা ডকুমেন্টারি ফিল্ম ও বঙ্গবন্ধুর আরও ছবি ফিল্ম ঢুকিয়ে দেন।

ওই সময় আমি স্যারকে বললাম, ‘স্যার, আমি একটু আমার বাবার সঙ্গে দেখা করে আসি?’ তিনি বললেন, ‘যাও’। বাবা বিজি প্রেসে চাকরি করতেন। আমি বাবাকে বললাম, ‘আমি দুই দিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। চিন্তা কইরেন না।'

সেখান থেকে সোজা অফিসে যাওয়ার পর মুহিবুর রহমান আমাকে রুমের ভেতর নিয়ে গেলেন। আমাকে নিয়ে রুমের ভেতর গিয়ে রেকর্ডসহ পালানোর পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় দিলেন এবং আমার হাত ধরে বললেন, ‘আমজাদ, আল্লাহ হাফেজ।’

ওনার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। উনি জানতেন যদি ধরা পড়ি তাহলে আমরা কেউ বাঁচব না।

এবার সচিবালয় থেকে বের হতে হবে, কিন্তু বাইরে বিভিন্ন স্থানে তখন পাকিস্তানি সেনাদের সতর্ক পাহারা ও টহল। সচিবালয়ে ঢোকার ফটক ‘সেকেন্ড গেইট’ দিয়ে বেরোনোর পরিকল্পনা করা হয়। ওই ফটকের দায়িত্বে থাকা বাঙালি পুলিশ সার্জেন্ট ফরিদও ছিলেন সেই পরিকল্পনায়। বেবি ট্যাক্সিতে করে বড় আকারের ট্রাঙ্ক নিয়ে রওনা হই। সংকেত পেয়ে ফটক খুলে দেন ফরিদ।

দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল। সচিবালয়ের টিনশেড থেকে ট্রাঙ্ক নিয়ে বের হয়ে প্রেসক্লাবের সামনে এসে দেখি, আর্মির জিপ। মেশিন গান নিয়ে জনতার দিকে তাক করে বসে আছে। ওইখান দিয়ে আমার বেবি সোজা চলে আসল। ‘কী আছে?’ বললেই তো আমি শেষ।

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের পাশ ধরে চাঁনখারপুল থেকে চকবাজার হয়ে সোয়ারিঘাটে পৌঁছে আমার বেবি ট্যাক্সি। এর পরের ধাপ নৌকা পারাপারের। সোয়ারিঘাটে যাওয়ার পর কুলিরা দৌড়ে আসল। বলল, ‘স্যার কী এটা?’ আমি বললাম, ‘তাড়াতাড়ি উঠাও।’ নৌকায় উঠাল। নৌকায় করে জিনজিরায় গেলাম।

নৌকায় বুড়িগঙ্গা পাড়ি দেওয়ার পর দেখি, শয়ে শয়ে লোক বাসের অপেক্ষায়। যে যেভাবে পারছে ঢাকা ছাড়ছে। দেখি, একটা বাস ছাইড়া যাইতেছে। বাসের পেছনে জোরে একটা থাপ্পড় মারলাম। থাপ্পড় দেওয়ার পরে ড্রাইভার পেছনের দিকে তাকাল। বাসের ভেতরে জায়গা না পেয়ে ট্রাঙ্কসহ ছাদে উঠি। এরপর পৌঁছাই নবাবগঞ্জের বক্সনগরে।

মুক্তিযুদ্ধের আগ মুহূর্তে ফিল্ম আর্কাইভে কর্মরত আমজাদ আলী খান।

সেখানে ঘোড়ার পিঠে ট্রাঙ্কটি উঠিয়ে চার-পাঁচ কিলোমিটার বা এর বেশি রাস্তা হেঁটে গেলাম। এরপর পৌঁছালাম জয়পাড়ায় মজিদ দারোগার বাড়িতে। ওই বাড়িতে ট্রাঙ্কটি রাখলাম।

ওই সময়ে মহিবুর রহমানও পৌঁছে যান সেই এলাকায়। কিন্তু দারোগা বাড়ির অবস্থান থানার কাছাকাছি হওয়ায় সেখান থেকে ট্রাঙ্কটি সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

তখন ওখান থেকে চর কুসাই নামে একটা গ্রাম আছে। ওইখানে হাজি দানেশ ও উমেদ খাঁ নামে দুই ভাইয়ের বাড়ি ছিল। ওই বাড়িতে উমেদ খাঁর ধানের গোলার ভেতরে লুকিয়ে রাখা হয় ট্রাঙ্কটি।
ধানের গোলায় মাসখানেক রাখার পর মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় ট্রাঙ্কটি ভারতে নিয়ে যান মহিবুর রহমান।

বিজয়ের পরপরই দেশে ফিরিয়ে আনা হয় সেই ভিডিও ফুটেজগুলো। সাদাকালো ওই ভিডিও ২০১৬ সালে রঙিন সংস্করণে রূপান্তরিত করা হয়।’

আক্ষেপ নিয়ে আমজাদ আলী খন্দকার জানান, এই ভাষণটি সংরক্ষণে অসীম সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২২ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিভাগে একুশে পদক লাভ করেন তিনি। তবে এখনও মেলেনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর চরমভাবে ভেঙে পড়েন এই সাহসী সৈনিক। চাকরি বাঁচাতে ফিল্ম ডিভিশন থেকে যান বাংলাদেশ টেলিভিশনে। দীর্ঘ কর্মজীবনে সেখানেও রেখেছেন কৃতিত্বের স্বাক্ষর।