logo
আপডেট : ৬ মার্চ, ২০২২ ২২:৪৫
নতুন আইন মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে বিশৃঙ্খলা আরও বাড়াবে: এমআইবি
নিজস্ব প্রতিবেদক

নতুন আইন মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে বিশৃঙ্খলা আরও বাড়াবে: এমআইবি

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গন আজ যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, তার পেছনে লেখক-শিল্পীদের পাশাপাশি বড় অবদান রয়েছে পৃষ্ঠপোষক তথা প্রযোজক-পরিবেশকদের। এই প্রযোজকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ও উদ্যোগে দেশের সংস্কৃতি যখন হাঁটছে বৈশ্বিক পথে- তখনই সামনে এসে দাঁড়ালো কিছু শঙ্কা।

প্রযোজকরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক সময়ে সংশোধিত কপিরাইট আইনে তাদের সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি। তারচেয়ে বড় ক্ষোভ, আইনটি পরিবর্তন-পরিমার্জন করার বিষয়ে প্রযোজকদের মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি। এর বাইরেও অনেকগুলো সম্ভাব্য বিধান নিয়ে তৈরি হয়েছে অসন্তোষ।

জানা গেছে, এরমধ্যে তৈরি হয়েছে কপিরাইট আইন ২০২১-এর খসড়া। যা শিগগিরই পাস হবে। তবে তার আগেই এই আইন নিয়ে তুমুল ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করছে খোদ মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এমআইবি)-এর নেতা ও সদস্যরা। তাদের অভিমত, নতুন কপিরাইট আইনের মাধ্যমে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে বিশৃঙ্খলা আরও বাড়বে। তাই নয়, ডিজিটাল মাধ্যমে নাটক, সিনেমা ও গান প্রকাশে তৈরি হবে নানা প্রতিবন্ধকতা। যা দেশ তথা ইন্ডাস্ট্রির জন্য সুখকর বার্তা বয়ে আনবে না।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কপিরাইট আইন- ২০২১-এ এমন কিছু আইন যুক্ত হচ্ছে যা প্রযোজক-শিল্পী-সুরকার-গীতিকবিদের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট করবে। পরস্পরের প্রতি যে আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে সেটিও নষ্ট হবে। তাই নয়, এই আইনের মাধ্যমে একজন শিল্পী-সুরকার-গীতিকার-নির্মাতা চাইলে তার সৃষ্টি কোনও প্রযোজকের কাছে এককালীন বিক্রি বা বিপণনের সুযোগ পাচ্ছে না। তারচেয়েও বড় বিষয়, শিল্পী-প্রযোজকদের যৌথ সম্মতিতে যে চুক্তিই হোক না কেন, সেটি যে কোনও সময় বাতিল করার অধিকার রাখবে কপিরাইট বোর্ড!

আরও জানা গেছে, কোনও প্রযোজক নাটক বা সিনেমা ক্রয় করার পর সেটির গান বা ক্লিপ আলাদা করেও পরিবেশন করতে পারবে না নতুন আইনের কারণে! যা প্রযোজকদের হাত-পা বেঁধে সমুদ্রে ফেলে দেওয়ারই নামান্তর বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এমআইবি)’র প্রধান এবং লেজার ভিশনের অন্যতম কর্ণধার একেএম আরিফুর রহমান বলেন, ‘আমরা যারা নিয়মিত কাজ করছি, তাদের সবকিছুই তো চলমান কপিরাইট আইনের ভিত্তিতে চলছে। কিন্তু আপত্তিটা নতুন আইনের কিছু সংশোধনী নিয়ে। যেটা মোটেই কাম্য নয়। আমার কথা, যার বা যাদের গান তারা যদি আমার চুক্তিপত্রে হাসিমুখে স্বাক্ষর করেন, সেটিতে অন্য পক্ষের হস্তক্ষেপ কেন থাকবে? ফলে নতুন যে আইনটি হচ্ছে সেটি আরও সঠিক, স্পষ্ট ও সংস্কৃতিবান্ধব হওয়ার দাবি জানাই।’

এই জ্যেষ্ঠ প্রযোজক মনে করিয়ে দেন, ‘ইন্টারনেটের মাধ্যমে গোটা বিশ্বের সংস্কৃতি এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। সেই সময়ে এসে আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে আইনের মারপ্যাঁচে জড়িয়ে ফেলছি। যা খুবই দুঃখজনক।’

এদিকে দেশের আরেক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সাউন্ডটেকের কর্ণধার সুলতান মাহমুদ বাবুল বলেন, ‘এই মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে পুরো জীবন কাটিয়ে দিয়েছি। নতুন আইন পাশ হলে মামলা আমাদের পেছন ছাড়বে না। এভাবে এই আইন পাস হলে আমাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ, নতুন আইনের মাধ্যমে পুরনো প্রযোজকরা ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য হবে। বিপরীতে নতুন কোনও ইনভেস্টর এই ইন্ডাস্ট্রিতে যুক্ত হবে না।’

যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরেনাই- এই ঐতিহাসিক গানের রচয়িতা, চেনাসুর-এর কর্ণধার ও এমআইবি’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হাসান মতিউর রহমান নতুন কপিরাইট আইন প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের অর্থায়নেই গড়ে উঠেছে অডিও শিল্প। তবুও আমরা কখনো বলিনি সবকিছু আমাদের দিয়ে দিন। বরাবরই চেয়েছি, একসঙ্গে থেকে আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশে এগিয়ে যেতে। কিন্তু বার বার সেই অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। হতাশার বিষয় এমন একটি আইন হচ্ছে, যেটা সম্পর্কে আমরা এখনও পুরোপুরি অন্ধকারে আছি। আমরা জানি না, এই আইনে আসলে কী আছে কী নেই। আইনটি চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে আমরা এটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই, এটুকুই দাবি করছি।’

এদিকে কপিরাইট আইন-২০২১ প্রণয়ন নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন দেশের আরেক অন্যতম প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিডি চয়েসের কর্ণধার জহিরুল ইসলাম সোহেল। তিনি বলেন, ‘গত ৫০ বছরে আমার মতো শত শত প্রযোজক প্রাণের টানে এই অঙ্গনে এসেছেন, ফিরে গেছেন নিঃস্ব হয়ে। আমরা এখনও যে ক’জন টিকে আছি, প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে চলেছি। নতুন আইন হলে এই কয়েকজনও বাড়ি ফিরে যাবো। তাই আমার আবেদন, আইনটি চূড়ান্ত করার আগে সবার মতামত নিন।’


চলচ্চিত্রভিত্তিক দেশের প্রাচীন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান অনুপম রেকর্ডিং মিডিয়া। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ও এমআইবি’র সহসভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন নতুন কপিরাইট আইন নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন। বলেন, ‘চার দশকের প্রতিষ্ঠান আমার। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে এ পর্যন্ত এসেছি। প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও গানের বিকাশে কাজ করার। অথচ এই পর্যায়ে এসে নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে। বর্তমানে যে আইন হচ্ছে বলে শুনছি, তাতে করে গান করার ইচ্ছা শক্তি হারিয়ে ফেলছি।’

এই প্রযোজকের দাবি, ‘যারা এই মাধ্যমটির অপরিহার্য অংশ, তাদের ছাড়া কিভাবে কপিরাইট আইনের সংশোধনী প্রস্তাব আনা হয়, তা আমাদের বোধগম্য নয়। সকল পক্ষকে নিয়ে একটি নির্মোহ আইন তৈরি করা দরকার।’

এদিকে দেশের আরেক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ঈগল মিউজিকের কর্ণধার কচি আহমেদ বেশ স্পষ্ট করেই তুলে ধরেন তাদের ক্ষোভ বা হতাশার বিষয়টি। তিনি বলেন, ‘ধরুন আমি একটি গান প্রযোজনা ও পরিবেশনার জন্য সংশ্লিষ্ট ক্রিয়েটরদের সঙ্গে চুক্তি করলাম। কিন্তু কপিরাইট বোর্ড চাইলে আমাদের সেই যৌথ চুক্তি বাতিল করতে পারবে! এটা কেমন কথা। তারমানে আমাদের কারও কোনও মতের বা স্বাধীনতার গুরুত্ব থাকছে না! এটা কেমন আইন। শুনছি নতুন কপিরাইট আইনে এমন কিছু ধারা যুক্ত হচ্ছে। যে আইনগুলো আমাদের মতো মানুষগুলোকে নিরুৎসাহিত করবে।’

যে কোনও নতুন আইন মানুষের মনে আশার আলো জাগায়। কারণ, সংশ্লিষ্টদের সুরক্ষার জন্যই আইনের সৃষ্টি। অথচ সেই সংশোধিত খসড়া আইন নিয়েই সংগীত প্রযোজক-পরিবেশক সংশ্লিষ্টরা আতঙ্কগ্রস্ত। প্রযোজকদের আবেদন, এই আইন প্রণয়নের আগে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বসে যেন চূড়ান্ত করা হয়।