logo
আপডেট : ৭ মার্চ, ২০২২ ১০:৪৩
লাশকাটা ঘর পর্ব-২
শিশুটি বুঝি কষ্ট পাচ্ছে...!
নিজস্ব প্রতিবেদক

শিশুটি বুঝি কষ্ট পাচ্ছে...!

প্রতীকী ছবি

আঙুল ইশারা করে কিছু একটা বলতেই পাশে দাঁড়ানো লোকটি ছুরি দিয়ে কাটে লাশের এক টুকরো মাংস। লোহার ট্রেতে মধ্যবয়সি এক ব্যক্তির লাশের ময়নাতদন্ত চলছে। লাশের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ফরেনসিকের ডাক্তার। দুজন ডোম। একজনের হাতে ধারালো ছুরি, অন্যজনের হাতে ইলেকট্রিকের করাত। পাশের টেবিলেও রাখা অনেকগুলো ছুরি-কাঁচি-করাত। ডাক্তার নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ডোম কেটে নেয় লাশের শরীরের বিভিন্ন অংশ। রেখে দেয় আলাদা আলাদা সাদা বয়ামে। কথা হয় ডোম বাবুলের সঙ্গে। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে মর্গ সহকারী হিসেবে কাজ করছেন তিনি।

বাবুল জানান, ‘লাশ কাটতে ভয় লাগেনি কখনো। তবে শুরুতে খারাপ লাগত। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের লাশ কাটতে গেলে মনের মধ্যে অন্যরকম একটা খারাপলাগা কাজ করত। ময়নাতদন্তের প্রয়োজনে কচি শরীরে ছুরি চালাতে হয়। তখন মনে হয়, শিশুটি বুঝি কষ্ট পাচ্ছে। আবার ভাবি, মৃত দেহে সেই অনুভূতি থাকে না। প্রাণ না থাকলে এটি শুধুই দেহ।’ মর্গের কাজ করতে গিয়ে অনেক ট্র্যাজেডির কথা মনে আছে। শত শত লাশ এসেছে একদিনে। আগুনে পোড়া লাশ। রক্তাক্ত, টুকরো টুকরো লাশ, পচা লাশ, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গবিহীন লাশও দেখতে হয়েছে। কাটতে হয়েছে। মর্গে কাজ করতেন বাবুলের বাবা, চাচা। শুরুর দিকে যখন বাবা, চাচার সঙ্গে মর্গে আসা-যাওয়া করতেন বাবুল তখন কিশোর। কিশোর বয়সে এসব লাশ দেখে বেশ কয়েকদিন শুধু ভেবেছেন, মৃত্যুর পর মানুষ তো জড় পদার্থের মতো হয়ে যায়। মৃত্যুর পর মানুষের প্রাণ কোথায় যায়...। এরকম নানা প্রশ্নের জন্ম হতো। নানা ভাবনা আসত মাথায়। ধীরে ধীরে বিষয়টি সহজ হয়ে গেছে।

বংশ পরম্পরায় ডোম হিসেবে কাজ করার কারণে পারিবারিকভাবে এ নিয়ে কোনো অনভিপ্রেত দৃষ্টিভঙ্গির শিকার হননি বাবুল। ডোম হিসেবে অনেকবার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। এনাটমি বিভাগে ক্লাস করেছেন। বাবুল বলেন, ডাক্তারের নির্দেশেই লাশ কেটে প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ করা হয়। শুরুতেই মর্গে যেখানে লাশ কাটা হয় ট্রেতে করে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় লাশ। নির্ধারিত পোশাক পরই ডাক্তারসহ লাশ কাটায় অংশ নেন তারা। বাবুল, সেকান্দার ও রামু কাজ করেন মর্গে। বাবুলের পূর্বের নাম গেসো। কয়েক বছর আগে সেকান্দার ও বাবুল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাদের দুই ভাই রাজা ও রামু এখনো সনাতন ধর্মেই রয়েছেন। বাবুল বলেন, ধর্ম পরিবর্তনের সঙ্গে পেশাগত বিষয়ের প্রভাব তো আছেই। তবে সেটি বিশ^াসের। বিশ^াসের কারণেই ধর্ম পরিবর্তন করেছি।

বাবুল বলেন, লাশকাটা ঘরে কাজ করার কারণে প্রতিদিনই প্রাণহীন দেহ দেখার পাশাপাশি স্বজন হারানোদের কান্নাও দেখতে হয়। স্বজনের লাশ মর্গে রেখে অনেকেই রাতভর পাহারা দেন বাইরে। এরকম অনেককে দেখেছেন। আবার রাতে একা একা লাশের আশপাশে থাকতেও ভয় পান অনেকে। এমনকি দিনের বেলাও মর্গে ঢুকতে ভয় পান কেউ কেউ। তবে মৃত ব্যক্তির আপনজনদের ক্ষেত্রে এ ভয়টা কমই থাকে। তারা আবেগ প্রবণ থাকেন। সাধারণত বিকেল ৫টার থেকে পরদিন সকাল ৯টা পর্যন্ত মর্গে কোনো লাশের ময়নাতদন্ত হয় না।