বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম প্রেরণা। ৭ই মার্চের ভাষণই নিরস্ত্র একটা জাতিকে সশস্ত্র হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে সবচেয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ও ২৬শে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা তার অনুপস্থিতিতে সমগ্র জাতিকে নয় মাস যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দিকনির্দেশনা, সাহস ও শক্তি যুগিয়েছিল। ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাঙালির আরাধ্য স্বাধীনতা। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, এ বাঙালি জাতির কোনো দিনই একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মালিকানা ছিল না। জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের চেতনা বলতে যা বুঝায় তার কোনো কিছুই ছিল না। বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্ন কখনোই স্পষ্ট রূপ নেয়নি। একমাত্র ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এই জনপদে ও বাঙালির ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই রাষ্ট্রের স্থপতি। জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ হেগেলের (১৭৭০-১৮৩১) ভাষায়, ‘মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হচ্ছে রাষ্ট্র সৃষ্টি করা।’
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ছিল ইতিহাসের অনিবার্যতা। ৭ই মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ দিনগুলোর একটি। বিভ্রান্তি ছিল প্রচুর, তবে সেটা ছিল কিছু তরুণ নেতাকর্মী ও জনতার একাংশের মধ্যে। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য অর্জনের জন্য কৌশল ও কর্মপরিকল্পনার মধ্যে কোনো বিভ্রান্তি বা দোদুল্যমানতা ছিল না। ১ মার্চ পাকিস্তানের সেনাশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য নবগঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের আহ্বানকৃত সভা স্থগিত করার পরক্ষণেই উত্তাল হতে থাকে ঢাকার রাজপথ। ২ মার্চ থেকে অসহযোগের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু, পুরো দেশ অচল হয়ে পড়ে। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু পল্টনে ঘোষণা করলেন ৭ই মার্চ জনসভায় তিনি জাতির উদ্দেশে বক্তব্য রাখবেন। দেশে-বিদেশে অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ওইদিন স্বাধীনতার ঘোষণা দিবেন।
৬ মার্চ বিশ্ববিখ্যাত ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার এক নিবন্ধে বলা হয়- শেখ মুজিব একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন। ৭ই মার্চ সকালে করাচি থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোতেও এমন আশঙ্কাই ব্যক্ত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস-সচেতনতা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতার সম্যক ধারণা এত প্রগাঢ় ছিল যে, তিনি কোনো অবস্থাতেই একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করে আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের তকমা লাগানোর সুযোগ দেননি। দেশে দেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ব্যর্থতা এবং এসব আন্দোলনের আন্তর্জাতিকভাবে অগ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আক্রান্ত হওয়ার আগেই একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করলে আমাদের কী পরিণতি হতো তার প্রমাণ হলো সাম্প্রতিককালের স্পেনের নিকট থেকে কাতালোনিয়ার একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা। কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা করে ওই দেশের নেতা কার্লেস পুজদেমন বিদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু পৃথিবীর একটি দেশও একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণাকারী কাতালোনিয়ার পাশে দাঁড়ায়নি বা দেশটিকে স্বীকৃতি দেয়নি। ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সবই বলেছিলেন শুধু একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণাটি ছাড়া। ‘...তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা (আক্রমণ নয়) করতে হবে। ...আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব...।’
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো এই ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ করে নিয়েছে এবং ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্ট্রারে অন্তর্ভুক্ত করেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এখন শুধু বাঙালির নয়, সারাবিশে^র তথা মানবসভ্যতার অহংকার। এ ভাষণ কালোত্তীর্ণ বিশ^ ক্লাসিক। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে অনেক কিছুই রয়েছে, যা চলমান সমসাময়িক বিশে^ খুবই প্রাসঙ্গিক। বিশে^র দেশে দেশে আঞ্চলিক ও গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব নিরসনে সমঝোতাকে প্রথমে বেছে নিতে হবে। সমঝোতার সব পথ রুদ্ধ হলেই অন্য পথ ধরতে হবে। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘...আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি...।’ রক্তক্ষয় ও হানাহানির পথে প্রথমেই না গিয়ে বরং এ পথকে পরিহার করে সমঝোতার চেষ্টা বিশ^বাসীর কাছে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।
গণতন্ত্র মানেই সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে প্রাধান্য দেওয়া নয়, এটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অন্যতম একটি শিক্ষা। বেশির ভাগ লোক যা বলবে তাই গণতন্ত্র, এটা বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক উপলব্ধি ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়- ‘...যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’
দুর্বল প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বা সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন আজকে বিশ্বের একটা অন্যতম সমস্যা। একটা সমাজের সংখ্যাগুরুদের দায়িত্ব হচ্ছে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর হেফাজত করা। ইরাক ও তুরস্কেও কুর্দিদের বা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের দুরবস্থার দিকে তাকালে আরো বেশি স্মরণে আসবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। রামু, নাসিরনগর বা গাইবান্ধার ঘটনা পুনরাবৃত্তি রোধেও প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুর এই দার্শনিক উক্তির অনুসরণ। বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শাশ্বত আহ্বান ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণে। ১ মার্চ থেকেই উত্তাল হতে থাকে রাজপথ। দেশজুড়ে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে হতাহত হয় অনেকেই। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে তাদের কথাও ভোলেননি।
বঙ্গবন্ধু এক বাক্যে বাঙালির ভবিষ্যৎ রচনা করে বলেছিলেন বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। তার শুধু একটি উদাহরণ পদ্মা সেতু। দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে কাল্পনিক দুর্নীতির অভিযোগ এনে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ^ব্যাংক যখন সরে গেল তখন এডিপি, জাইকাসহ আরো নানা উন্নয়ন সহযোগী পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে সরে যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করবেন।
রাজনীতি যারা করবেন তারা ক্ষমতাকে ভোগ করার জন্য রাজনীতি করবেন না। জনগণের জন্য আত্মত্যাগই হচ্ছে রাজনীতির মহৎ উদ্দেশ্য। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাদের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখাই রাজনীতি। বঙ্গবন্ধু তার সারাটি জীবন মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছেন, যৌবনের ১৩টি বছর জেলখানায় নির্জন প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন। বলেছেন, ‘...আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’
বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার সংগ্রাম কথাটা বলেই ক্ষান্ত হননি, মুক্তির সংগ্রামের কথাটাও যোগ করেছিলেন, যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও বঙ্গবন্ধুর মনে মুক্তির সংগ্রামের তাৎপর্য লুকানো ছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি একবার উচ্চারিত হলেও ‘মুক্তি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন কয়েকবার, ‘...আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়’, ‘... এ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে’, ‘...যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হয়’, ‘... এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ’, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারে সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
স্বাধীনতার সংগ্রামের চেয়ে মুক্তির সংগ্রাম অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। যদিও মুক্তির জন্য স্বাধীনতা অপরিহার্য। স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে পরাধীনতার অবসান হলেও মানুষ অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি অর্জন করে না। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি প্রথম একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের মালিক হয়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির সংগ্রাম শুরু হতেই সেই অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেওয়া হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা ছিল সবাই মিলেমিশে একটি বহুমাত্রিক বহুবাচনিক উদার গণতান্ত্রিক সমাজ। যার মধ্য দিয়ে মানুষের মুক্তি আসবে। অর্থনৈতিকভাবে আমরা দ্রুত এগোচ্ছি। আমরা অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় পৌঁছে গেছি।
বিশ্বব্যাংকের নির্ধারিত মানের বিচারে মাথাপিছু ডলারের হিসাবে আমরা মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় স্থান করে নিচ্ছি। ২০৪১ সালে আমরা উন্নত দেশে পরিণত হব, তবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দৃঢ়ভাবে না ধরলে এ উন্নয়ন টেকসই হবে না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আমাদের মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মুক্তির সংগ্রাম চলে নিরন্তর। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মানুষের মুক্তির সংগ্রাম অব্যাহত থাকুক- এটাই আজকের প্রত্যাশা।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়