দিনাজপুর জেলায় আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে তালাকের সংখ্যা। আর এই বিবাহ বিচ্ছেদে এগিয়ে রয়েছে নারীরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার, মাদকের কু-প্রভাব ও নির্যাতনের কারণে বেড়েছে তালাকের প্রবণতা। এসব থেকে রক্ষা পেতে কঠোর আইনি ব্যবস্থার পাশপাশি প্রয়োজন পারিবারিক নৈতিক শিক্ষা প্রদান এবং সামাজিক সচেতনতা।
পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, প্রতিমাসেই তালাকের আবেদন পড়ে প্রায় ৪০ থেকে ৫০টি। আর মাসে দুইবার পরিষদের তালাকসংক্রান্ত সালিসি বৈঠক বসে।
সূত্রটি আরও জানায়, গত ১ মার্চ, মঙ্গলবার বিবাহ বিচ্ছেদের ৩৬টি বৈঠক ডাকা হয়, যার মধ্যে ২৭টি বৈঠক ডাকা হয় নারী পক্ষ থেকে। এরমধ্যে শিক্ষিত মেয়েরাই বেশি।
জেলা রেজিস্ট্রার অফিস সূত্রে জানা যায়, দিনাজপুরে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুসলিম শরিয়াহ অনুয়ায়ী বিয়ে হয়েছে ১৫ হাজার ৮০২টি, আর তালাক হয়েছে ৬ হাজার ১২৪টি।
এরমধ্যে ছেলে পক্ষ থেকে তালাক দিয়েছে ১ হাজার ১৮০ জন। মেয়ে পক্ষ দিয়েছে ২ হাজার ৫৫৫ জন। ছেলে-মেয়ে উভয়ই তালাক দিয়েছে ২ হাজার ৩৮৯ জন।
সূত্রটি আরও জানায়, দিনাজপুরে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিয়ে হয়েছে ১২ হাজার ২৬৭টি। তালাক হয়েছে ৫ হাজার ৫৩০টি। একইভাবে ২০১৯ সালে বিয়ে হয় ১৫ হাজার ৬৮৮টি, আর তালাক হয় ৫ হাজার ৬৭৬টি।
২০১৮ সালে বিয়ে হয় ১৫ হাজার ৫৫৯টি, তালাক হয় ৫ হাজার ২০৮টি। ২০১৭ সালে বিয়ে হয় ১৪ হাজার ২৬৪টি, তালাক হয় ৫ হাজার ৩৪৫টি।
এ বিষয়ে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মিন্টু কুমার পাল বলেন, ‘দিনাজপুরের তালাকের প্রবণতা কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সিদ্ধান্তের অভাব। ছাত্রজীবনে ছেলেমেয়ে পছন্দ করে বিয়ে করছে যা পরিবার মেনে নিতে পারছে না। ফলে তালাকের পরিমাণ বাড়ছে।’
একইসঙ্গে বলা যায়, করোনার কারণে সংসারে টানাপোড়েনে বেড়েছে তালাক। এছাড়া নেশায় আসক্ত ছেলেরা স্ত্রীকে নির্যাতন করে থাকে। যার কারণে তালাকের প্রবণতা বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও এর জন্য দায়ী। আমার মনে হয়ে, এ থেকে উত্তরণ হওয়ার জন্য প্রয়োজন কঠোর আইনি ব্যবস্থা।
অ্যাডভোকেট সাথী দাস বলেন, ‘তালাক বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ, বর্তমানে নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছে। তারা অন্যের টর্চার সহ্য করতে পারছে না। তাই সমাজে তালাকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এখন অনেক পরিবারই তালাকের জন্য প্ররোচিত করে। আর এর জন্য শুধু মেয়েদের দায়ী করা ঠিক হবে না। সমান দায়ী ছেলেরাও। নেশায় আসক্ত ছেলেরাই টর্চার করে। এসব কারণেই কিন্তু তালাকের প্রবণতা বাড়ছে।’
আমি মনে করি, তালাকের বিষয়ে আইনি সংশোধনের প্রয়োজন। এটি সম্ভব হলে তালাকের প্রবণতা কমে আসবে।
দিনাজপুর পৌরসভার তালাকসংক্রান্ত সালিসি পরিষদে প্রধান প্যানেল মেয়র আবু তৈয়ব আলী দুলাল বলেন, ‘নারীরা তালাকে এগিয়ে। প্রতিমাসে পৌরসভায় প্রায় ৪০ থেকে ৫০টি তালাকের আবেদন পড়ে। এর মধ্যে হয়তো দুই-একটির সমাধান হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের চিঠি দিয়ে পাওয়া যায় না। ফলে বাধ্য হয়ে আবেদন কার্যকর হয়ে যায়।’
কাজী মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, ‘তালাকের প্রবণতায় মেয়েরাই অনেক এগিয়ে। এর মূল কারণ হলো ‘নেশা’। নেশার কারণে অনেক স্বামী টর্চার করে স্ত্রীর ওপর। যার কারণে মেয়েরা বাধ্য হয়ে তালাক দিয়ে থাকেন।’
আবার কিছু মেয়েরা সম্পদের লোভে বিয়ে করে পরে স্বামীকে তালাক দিয়ে থাকেন। এর মধ্যে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরাই বেশি দায়ী। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় পুলিশ প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপে নেশার প্রভাব কমাতে হবে।