logo
আপডেট : ৮ মার্চ, ২০২২ ০৯:৪২
আলেয়া যেন ‘মাদার তেরেসা’
তারেক মাহমুদ, রাজশাহী ব্যুরো

আলেয়া যেন ‘মাদার তেরেসা’

রোগী নিয়ে যাচ্ছেন রামেক হাসপাতালের দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মী আলেয়া বেগম

বিকারগ্রস্ত কিংবা মানসিক ভারসাম্যহীন। কারো শরীর বা হাত-পায়ের অংশ পচা। কারো শরীরে ধরেছে পোকা। চরম সংকটময় পরিস্থিতিতেও পাশে নেই নিজেদের স্বজন। এমন অসুস্থ অভিভাবকহীন মানুষের সেবাই একমাত্র ব্রত হিসেবে নিয়েছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মী আলেয়া বেগম।

গত ১৩ বছর ধরে নিজের সামর্থ্যরে সর্বোচ্চটা দিয়ে শত শত অসহায় দুঃখী অসুস্থ মানুষের মুখে হাসি ফোটাচ্ছেন এই শ্রমজীবী নারী। তার কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ হয়ে কেউ কেউ তাকে বলেন, ‘দেবদূত’, অনেকেই বলেন, একালের ‘মাদার তেরেসা’।

এ দিকে রামেক হাসপাতালের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাইরে পাশাপাশি অনেকগুলো বেড। সেখানে চিকিৎসাধীন বেওয়ারিশ, অসুস্থ ও ভারসাম্যহীন রোগীরা। যাদের বিলাপ, প্রলাপ, আহাজারিতে বিরক্ত অন্যান্য সেবাপ্রতাশীরা। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের বিপন্ন দীর্ঘশ্বাস ও বিষণ্ন দৃষ্টি এড়িয়ে যান দায়িত্বরতরাও। তবে ব্যতিক্রম আলেয়া বেগম।

রোগীর সেবা করছেন আলেয়া

স্বজনহীন রোগীদের সেবা-শুশ্রুষা করায় তার কর্ম-ধর্ম ও নেশা। গত ১৩ বছর ধরে হাসপাতালে আসা এমন শত শত রোগীর স্বজন হয়ে করেছেন চিকিৎসার ব্যবস্থা। এ নিয়ে অনেকেই তাকে পাগল আখ্যা দেন, বলেন নানা কটুকথা। সেসব উপেক্ষা করে নিজের সামান্য উপার্জন এবং চেয়ে-চিন্তে আনা অর্থ দিয়েই পাশে দাঁড়ান অবহেলিতদের। দিন-রাত খেটে সুস্থ করে তুলতে পারলেই আলেয়ার মুখে ফোটে হাসি। চিকিৎসার পর অনেককেই পৌঁছে দিয়েছেন আপন নীড়ে। নিজের বাড়িতেও স্থান দিয়েছেন এক প্রতিবন্ধী ছেলেকে।

৩৫ বছর বয়সি আলেয়া বেগম। দীর্ঘদিন ধরে রামেক রামেক হাসপাতালে ট্রলিটানার কাজ করতেন। বর্তমানে হাসপাতালে দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিকের (পরিচ্ছন্নতাকর্মী) কাজ করছেন। কাজের ফাঁকে হাসপাতালে আসা স্বজনহীন রোগীদের খোঁজ করেন। এমন কাউকে পেলেই আপন করে নেন। তিনিই সেই সব রোগীর স্বজন হয়ে যান। কয়েক বছর ধরে কয়েকশত মানুষকে সুস্থ করে চলেছেন তিনি।

রামেক হাসপাতালে আলেয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনি সিরাজগঞ্জ সদরের খাজা গ্রামের বাসিন্দা। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হওয়ায় মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় আলেয়াকে। পরিবারের পক্ষ থেকে বিয়ের পর যৌতুকের টাকা পরিশোধ করতে সক্ষম না হওয়ায় স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যান। ২০০৩ সালে দেড় বছরের মেয়েকে নিয়ে রাজশাহী চলে আসেন তিনি।

সংসার চালানোর জন্য প্রথমে পুরোনো বই বাঁধাইয়ের কাজ শুরু করেন। পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স নূরজাহান বেগমের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তিনিই হাসপাতালে কাজের ব্যবস্থা করে দেন। বর্তমানে রাজশাহী মহানগরের হেতেমখাঁ এলাকায় ভাড়া বাড়িতে থাকেন আলেয়া। পরিবার বলতে তার মা রওশন আরা ও মেয়ে টুম্পা।

মানসিক প্রতিবন্ধী রোগী নিয়ে যাচ্ছেন আলেয়া বেগম

রামেক হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, আলেয়ার কাছে এখন চারজন অভিভাবকহীন রোগী ছিলেন। তারা ভালোমতো কথা বলতে পারেন না। নিজের বাড়ির ঠিকানা বলতে পারেন না। সারা দিন দম ফেলার সময় নেই আলেয়ার। রোগী বেশি হলে সেই সকালে হাসপাতালে যান আর গভীর রাতে ফিরতে হয়।

আলেয়া বলেন, ‘হাসপাতালে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করছি। এখনো চাকরি স্থায়ী হয়নি। অনেক সময় ঠিকাদাররা আমাকে বাদ দিয়ে দেয়। কিন্তু চিকিৎসকরা সেবার জন্য বারবার ফিরিয়ে আনেন। হাসপাতালের চাকরিটা অন্তত স্থায়ী হলে আর কোনো চিন্তা করতে হবে না। কাজ করে যা পাই তা দিয়ে সংসার চলে না। তার পরে বড় অংশ এই রোগীদের পেছনে খরচ করতে হয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘অনেক রোগীর সব ওষুধ হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয় না। তখন অনেকের কাছে থেকে কিছু টাকা তুলে তাদের ওষুধ কিনি। কোনো কিছুর আশায় এসব করছি না। জীবন যতদিন বেঁচে আছি আমি এভাবে মানুষের সেবা করে যাব।’

রামেক হাসপাতালের সিনিয়র নার্স রেবেকা বেগম বলেন, ‘আলেয়া দীর্ঘদিন ধরে মানবসেবায় নিয়জিত। সে থাকায় আমাদের কাজ করা অনেক সুবিধা হয়। দিন-রাত সব সময় আলেয়াকে পাওয়া যায়। হাসপাতালে কোনো অভিভাবকহীন রোগী আসলে আলেয়া অভিভাবক হয়ে সেবা করে সুস্থ করে তোলে।’

স্বাস্থ্যকর্মী সুশান্ত কুমার বলেন, রামেক হাসপাতালে অভিভাবকহীন রোগীদের যখন কেউ থাকে না তখন আলেয়া কোনো স্বার্থ ছাড়াই কাজ করে। দীর্ঘ সময় সে এসব অসহায় মানুষের সেবা করে আসছে। একটি ছোট বাচ্চাকে যা করা হয় তার চেয়ে বেশি করে আলেয়া।

‘আলেয়া বাসা থেকে খাবার রান্না করে নিয়ে আসে। অসুস্থ মানুষগুলোকে গোসল, মেডিসিন খাওয়ানোসহ যাবতীয় কাজ করে। তার একটা ব্যবস্থা করা দরকার।’

রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘আলেয়া যে কাজটা করছে এটা মহৎ কাজ। সে অসহায় রোগী সেবায় নিরালসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। হাসপাতালের চিকিৎসক নার্সদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে চিকিৎসার সব নির্দেশনা মেনেই অসহায় রোগীদের সুস্থ করে তুলছে। তার বিষয়ে আমরা হাসপাতালের কাজ করার জন্য স্থায়ী হওয়ার বিষয়টি দেখছি।’