করোনা মহামারির মধ্যে দেশ-বিদেশে ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি সামগ্রিক পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আজ যে পণ্যে ১০ টাকা, রাত পোহাতেই তা হয়ে যাচ্ছে ১৫ টাকা। কয়েক দিন আগে এক লাফে মানভেদে ভরিপ্রতি স্বর্ণের দাম দুই থেকে সোয়া ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণ ৭৮ হাজার ২৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে সপ্তাহের ব্যবধানে মানভেদে টনপ্রতি রডের দাম বেড়েছে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। একটন রডের দাম ৮৬ থেকে ৮৮ হাজার টাকায় পৌঁছেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে না সামনের পরিস্থিতি কী হবে। সচেতন মহল বলছেন, ইউক্রেন ইস্যুতে অহেতুক মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর প্রতিকারে সরকারের কঠোর মনিটরিং জরুরি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। সরবরাহকারীরা বলছেন, সরকারের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে তারা বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখছেন। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি থেকে শুরু করে পণ্যের কাঁচামালের যে পরিমাণ মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, তা স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। যার খেসারত দিতে হবে, দেশের উদ্যোক্তা ও সাধারণ মানুষকে।
জানা গেছে, গেল বছর জানুয়ারিতে (২০২১) ভালো মানের রড (৬০ গ্রেডের) টন প্রতি দাম ছিল ৬৫ হাজার টাকা থেকে ৬৭ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। যা ২০২১ সালের নভেম্বরে এসে এই দাম দাঁড়ায় ৮০ হাজার টাকায়। ২০২২ সালের শুরুতে দাম কিছুটা কমে ৭৬ হাজার টাকায় আসে। ফেব্রুয়ারির শেষে ফের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে নির্মাণ কাজে অতি আবশ্যক এই পণ্যের দাম। অঞ্চলভেদে বর্তমান বাজারে প্রতি টন (ভালো মানের) রড বিক্রি হচ্ছে ৮৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। খুচরা ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, গত এক সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিন পণ্যটির মূল্য পর্যায়ক্রমে বাড়ছে।
বাজার পরিস্থিতির বিষয়ে বিএসআরএম স্টিল কোম্পানির মুখপাত্র শেখর রঞ্জন কর ভোরের আকাশকে বলেন, বাজার পরিস্থিতি শুধু যে ইউক্রেনের কারণে হচ্ছে তা কিন্তু না। বিশ^ বাজারে মেল্টিং স্ক্যাপের দাম বেড়েছে, জ¦ালানি তেলের মূল্য বেড়েই চলছে। অন্যদিকে ডলার শক্তিশালী হচ্ছে। এ ছাড়া- পণ্য জাহাজীকরণের খরচ বৃদ্ধিসহ আনুষঙ্গিক কারণে লোহা ও রড উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যে কারণে দাম বাড়ছে।
দাম বৃদ্ধির ফলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রড কেনা বন্ধ করেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে, একই দাবি রিহ্যাব নেতাদের। এর ফলে সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং আবাসন খাত বাধার সম্মুখীন হবে কি? এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্পে রডের ব্যবহার খুব কম। এর সঙ্গে যেসব পণ্য রয়েছে তার সঙ্গে রড একটি উপকরণ। রডের দাম বাড়ার কারণে প্রকল্প বা আবাসন খাতে তেমন প্রভাব ফেলবে না। তবে এটি দীর্ঘ মেয়াদি হলে সমস্যা তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া যুদ্ধ কত দিন স্থায়ী হবে তার ওপরও নির্ভর করবে বাজার পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে। তবে, বাজারে পর্যাপ্ত রড সরবরাহ রয়েছে। এখনো সংকট তৈরি হয়নি।
এ বিষয়ে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহ-সভাপতি এবং স্কাইরোজ বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল মাহমুদ ভোরের আকাশকে বলেন, বছরের শুরুতেই রডের দাম বেড়েছে। তখন তো যুদ্ধ ছিল না! এখন যুদ্ধ একটা অজুহাত। একেক সময় একেক অজুহাতে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়তে থাকে। এতে লোকসানে পড়তে হচ্ছে খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের। নতুন করে রডের দাম বাড়ার কারণে ফ্ল্যাট ব্যবসায় ধস নামবে।
এ ছাড়া যেসব নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে তা বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। এতে একদিকে যেমন ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে খাতসংশ্লিষ্ট প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তিনি বলেন, যুদ্ধ ছাড়াই গত তিন মাসে রডের দাম ৩৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন যুদ্ধ শেষে কত বাড়ে তা ধারণা করা যাচ্ছে না।
ঢাকার রড ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আপাতত পণ্য স্টক (সংরক্ষণ) বন্ধ রয়েছে। যখন যা থাকছে তা বিক্রি করা হচ্ছে। তাদের মতে প্রতি ঘণ্টায় দাম উলট-পালট হচ্ছে। অগ্রিম বিক্রিও বন্ধ রয়েছে বলে দোকানিরা জানিয়েছেন।
এদিকে সিমেন্টের দাম প্রতি ব্যাগে ১০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সম্পর্কে ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারে প্রতি ব্যাগ ফ্রেস সিমেন্ট ৪২৫ টাকা থেকে বেড়ে ৪৩৫ টাকা, সেভেন হর্স ৪১৫ টাকা থেকে বেড়ে ৪২৫ টাকা, আকিজ, সেভেন রিং ৪৪০ টাকার পরিবর্তে ৪৪৫ টাকা, আনোয়ার স্পেশাল, মীর, বেঙ্গল, আমান সিমেন্ট ৪২০ টাকার পরিবর্তে ৪২৫ টাকা, ক্রাউন সিমেন্ট ৪৪৫ টাকা এবং শাহ স্পেশাল ৪৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৪০ টকায় বিক্রি হচ্ছে।