logo
আপডেট : ৯ মার্চ, ২০২২ ১০:৫২
ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্যে সংকটে আমজনতা
নিজস্ব প্রতিবেদক

ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্যে সংকটে আমজনতা

বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত ১৬ ফেব্রুয়ারি একটি হিসাব প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, দেশে জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতির হার কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আর বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অব ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলছে, মূল্যস্ফীতি এখন ১২ শতাংশের বেশি। তাদের মতে, সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার এখন ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। গ্রামে এই হার ১২ দশমিক ১০ শতাংশ।


বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এর বহু কারণ রয়েছে। নানাজন নানাভাবে বিষয়টি বিশ্লেষণ করবেন। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। ১১০ ডলারের ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। গত আট বছরের মধ্যে এটা সর্বোচ্চ। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সেচখরচ ও পরিবহণ ব্যয় বৃদ্ধিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমরা যেসব পণ্য আমদানি করি, তার ব্যয় বৃদ্ধির কারণেও দাম বাড়বে। যদি আমরা এসব পণ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতাম, তাহলে কোনো কথা ছিল না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য হলোÑ চাল, ডাল, তেল, চিনি ইত্যাদি। এখন দেখা দরকার এসব পণ্য উৎপাদনে আমরা কতটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আমদানিনির্ভরতা কতটুকু। তাহলে বোঝা যাবে, পণ্যের দাম কেন এতটা বাড়ছে।


করোনার কারণে দীর্ঘ প্রায় দুই বছর অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে দেশের সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক সংকট এখনো দৃশ্যমান। এরই মাঝে তারা অনেকটা চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে আছেন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাতে। বাজারে মোটা চালের কেজি উঠেছে ৫০ টাকায়, ৭০ টাকা ছুঁয়েছে সরু চালের দাম। ডালের কেজি ১৩০ টাকা। বহুল ব্যবহৃত ভোজ্যতেল সয়াবিনের দাম লিটার ১৯০ টাকা। চিনি প্রতিকেজি ৮৫ টাকার বেশি। চলমান সমস্যার গভীরতা অনুধাবন করে আমদানি শুল্ক হ্রাস করছে সরকার। অবারিত করা হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি। আমরা কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলে অহরহ গর্ব করে থাকি। তা সত্যও বটে। উৎপাদন অবশ্যই বেড়েছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী বেড়েছে কি? চাহিদাও কি আমাদের বাড়েনি গত কয়েক দশকে? এই কারণে দেখা যাচ্ছে, বড় ধরনের আমদানিনির্ভরতা এখনো রয়ে গেছে আমাদের।


২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রাথমিক পণ্যের আমদানি খরচ ছিল ১ হাজার ৯৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে যায় ৭২৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত তার পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। চাল আমদানির পরিমাণ ২০১৬-১৭ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল কম, যথাক্রমে ১৩৩ হাজার এবং ২০৬ হাজার টন। কিন্তু ২০১৭-১৮ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে তা অনেক বৃদ্ধি পেয়ে যথাক্রমে ৩৯ লাখ এবং সাড়ে ১৩ লাখ টনে এসে দাঁড়ায়।


সম্প্রতি মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষে রয়েছে এই ভোজ্যতেল। ১ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৯০ টাকা, ভাবা যায়! যারা বাজার দর সম্পর্কে সচেতন, নিয়মিত বাজারে যান, তারা বোঝেন আসল পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে? পাম অয়েল ও সূর্যমুখী তেলের দামও অনেক চড়া। দেশে উৎপাদিত ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধির হার অপেক্ষাকৃত কম। সরিষা, তিল, তিসি ও রাইস ব্র্যান তেলের ক্ষেত্রে তেমন বাড়েনি দাম। মূল্যবৃদ্ধির জোর ধাক্কা লেগেছে আমদানিকৃত তেলের ওপর। করোনার অভিঘাতে বিদেশে সয়াবিন ও পাম অয়েলের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে আমদানি মূল্য ও পরিবহন খরচ। তাতে বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম। বাংলাদেশে তেলবীজের মোট উৎপাদন ৫ লাখ ৬০ হাজার টন। বার্ষিক চাহিদা রয়েছে ২২ লাখ ৩৮ হাজার ৬০৮ টন তেলবীজের। উৎপাদিত তেলবীজের ৬৪ শতাংশ সরিষা। বাকি ৩৬ শতাংশ হিস্যা রয়েছে সয়াবিন, বাদাম, তিল, তিসি ও সূর্যমুখীর। বছরের পর বছর ভোজ্যতেলের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৩ সালে জনপ্রতি দৈনিক ভোজ্যতেল ভোগের পরিমাণ ছিল ১১.৮ গ্রাম। ২০২০ সালে তা ২২ গ্রামে উন্নীত হয়। তাতে বৃদ্ধি পায় ভোজ্যতেলের মোট চাহিদা ও আমদানি।


বাংলাদেশে কৃষির উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আমদানিও করতে হচ্ছে অনেক। তা প্রতিস্থাপনের জন্য উৎপাদনের পরিমাণ আরো বাড়ানো প্রয়োজন। কৃষকদের সহায়তা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছেন। প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন। কৃষি খাতে উদার ভর্তুকির ব্যবস্থা করেছেন।
সার্বিক দিক সঠিকভাবে বিবেচনা করে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে সংশ্লিষ্টরা উদ্যোমী ভূমিকা রাখবেন- এটাই সবার প্রত্যাশা।


লেখক : প্রোগ্রাম অর্গানাইজার, আরবান ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম, ব্র্যাক