logo
আপডেট : ৯ মার্চ, ২০২২ ১১:০৭
নগর কৃষির সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
নিজস্ব প্রতিবেদক

নগর কৃষির সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

‘নগর-কৃষি’ শহরে বসবাসকারী সব নাগরিকের জন্য স্বস্তির বিষয়ে পরিণত হতে পারে

নিরাপদ, সতেজ ও পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার কে না চায়? কোভিড-১৯ অতিমারিকালীন সময়ে এর গুরুত্ব বেড়েছে বহুখানি। এই নিরাপদ, সতেজ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের অন্যতম জোগানদাতা হয়ে উঠতে পারে ‘নগর-কৃষি’, যা শহরে বসবাসকারী সব নাগরিকের জন্য স্বস্তির বিষয়ে পরিণত হতে পারে। তা ছাড়া, নগরীর দাবদাহ বা উষ্ণতা কমানোর অন্যতম উপায় হয়ে উঠতে পারে নগর-কৃষি। নগর-কৃষি একটি সম্ভাবনাময় ধারণা বিধায়, নগর-কৃষিকে ঘিরে সরকার কর্তৃক বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এর সম্ভানাসমূহকে খোঁজা হচ্ছে।


নগর-কৃষি বলতে শহরে বা শহুরে এলাকার আশপাশে বাড়ির ছাদে, বারান্দায়, ব্যালকনিতে ও বিল্ডিংয়ের নিচে, পাশে বা খোলা জায়গায় শাকসবজি ও ফলমূলের চাষাবাদ করাসহ কবুতর, পাখিপালন, পশুপালন, খাঁচায় বা গর্তে বা ড্রামে মাছ চাষ, মৌ-চাষ ও মাসরুম চাষকে বোঝায়। তবে, ছাদকৃষিকেই নগর-কৃষির অন্যতম ধারক বলা হয়। এটির বাণিজ্যিক সম্ভাবনাও রয়েছে প্রচুর। পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে অতিরিক্ত আয়ের উৎস হতে পারে ছাদবাগান। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সবুজ নগরায়ণের গুরুত্ব বেড়ে গেছে অনেকখানি। নগরবাসীকে তাজা উৎপাদনের উৎস, উন্নত খাদ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ পরিবারের বাজেট সঞ্চয় প্রদান করতে পারে এ নগর-কৃষি। সবুজ ছাদ ভবনগুলোর শব্দ কমাতে সাহায্য করে। পশ্চাৎগামী এবং অগ্রবর্তী সংযোগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক সুবিধা তৈরি করে দিতে পারে। নগর-কৃষিকে কেন্দ্র করে শহুরে নারীর উদ্যোক্তা সৃষ্টি হওয়ারও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। পরিবেশের উন্নতিতে, নগরীর দাবদাহ কমাতে, অবসর সময় কাটাতে, মানসিক প্রশান্তি আনতে, নান্দনিক মূল্যবোধ তৈরি করতে এবং সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করতে ছাদবাগানের জুড়ি মেলা ভার।


২০১৫ সালে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে ‘খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার উন্নতিতে শহুরে উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটির লক্ষ্য ছিল- তাজা-পুষ্টিকর শাকসবজি ও ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য এবং পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলার জন্য শহর এলাকায় ছাদের বাগান স্থাপন, সম্প্রসারণ ও প্রচার করা।ওই প্রকল্পের একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, ঢাকা এবং চট্টগ্রামে শহর এলাকায় ছাদবাগানে প্রায় ২৫ রকমের সবজি ও ২০ রকমের ফলসহ বহু প্রজাতির ফুল ও ঔষধি গাছ লাগিয়ে থাকেন বাসিন্দারা। শহরে বসবাসকারী এবং কর্মরত মানুষের কাছে সবুজ স্থানের মূল্য ক্রমবর্ধমানভাবে স্বীকৃত হচ্ছে। সবুজ পৃষ্ঠের গাছপালা তাপ শোষণ করে এবং তা বাষ্পীভবনের মাধ্যমে তাপমাত্রা হ্রাস করে। গবেষণায় উঠে এসেছে, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের পাশাপশি সবুজ-নগরায়ণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার অন্যতম এশটি কৌশল হতে পারে।


সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘের জলবায়ু রিপোর্টে এ আশঙ্কা করা হয়েছে যে, পৃথিবী পৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব যেমন- তীব্র খরা, জলোচ্ছ্বাস ও ভয়াবহ বন্যার দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। উষ্ণায়নের এ নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে উন্নত দেশগুলো কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। এর মধ্যে নগর-কৃষি পরিকল্পনা অন্যতম। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ৬৭% লোক চলে আসবে নগর এলাকায়। তাই, তারা নগর-কৃষিকে নিয়েই ভাবছে বেশি। চীনের সাংহাইয়ের সানকিয়াও আরবান ফার্মিংয়ের কথাই ধরা যাক। সেখানে ১০০ হেক্টর জমির ওপর তৈরি হচ্ছে আধুনিক কৃষিনগরী। আমাদের দেশেও নগর-কৃষিতে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটি বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টারই প্রতিফলন।


আধুনিক নগর-কৃষির জন্য দরকার হবে সুষ্পষ্ট নগর-কৃষি পরিকল্পনা। নগর-কৃষির সম্প্রসারণ হবে ঊর্ধ্বমুখী। তবে, বহুমুখী হওয়ারও সুযোগ রয়েছে যেমন- ব্যালকনি, বারান্দা এবং আশপাশের খোলা জায়গায়। তবে, ছাদকৃষি অন্যতম। দেশেই সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের ভিতর নিয়ন্ত্রিত আলো-বাতাসে চাষ হওয়ার সুযোগ রয়েছে সতেজ ফসলের। যেমন- নেদারল্যান্ডসে টেলিকমিউনিকেশন্স প্রতিষ্ঠান ফিলিপসের বাতিল করে দেওয়া ছয় তলাবিশিষ্ট বিশাল ভবনটি হয়ে উঠেছে ইউরোপের সবচেয়ে বড় নগর-কৃষির অন্যতম ক্ষেত্র। জাপানে নগরে বসবাসরত ২৫ ভাগ পরিবার কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত। টোকিও শহরে প্রায় ৭ লাখ নাগরিকের সবজি আসে নগর-কৃষি থেকে। নিউইয়র্কে প্রায় ১০০ একর জমি ব্যবহৃত হচ্ছে নগর-কৃষিতে। কেনিয়ার নাইরোবিতে খাদ্য অপ্রতুলতার জন্য পুরোদমে চলছে নগর-কৃষির ব্যাপক কার্যক্রম।


জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা পৃথিবীতে ৮০ কোটি লোক নগর-কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এরা মোট উৎপাদিত খাদ্যের ১৫-২০ ভাগ উৎপাদন করে থাকে। নেদারল্যান্ডস নগর-কৃষিতে সমৃদ্ধ বলেই ছোট্ট দেশ হয়েও নিজেদের চাহিদা পূরণ করে সারা পৃথিবীতে সম্প্রসারণ করতে পেরেছে খাদ্যপণ্যের বাণিজ্য। হংকংয়ে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নগর-কৃষির সঙ্গে যুক্ত। এ ছাড়া হংকংয়ে ‘রুফটপ রিপাবলিক’ নামে একটা গ্রুপ তৈরি হয়েছে, যারা পরিচালনা করছে ৩৩টি খামার। এটিই বিশ্বের জন্য অনন্য উদাহরণ। কৃৃষিকে নগরে আনার মাধ্যমে একদিকে যেমন নিরাপদ ও সতেজ খাদ্যের জোগানের প্রচেষ্টা যেমন চলছে, অন্যদিকে তেমনি পৃথিবীকে বায়ুম-লের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য সবুজ রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ।


শহর এলাকার আশপাশে বহু জমি আবাসন প্রকল্পের জন্য রয়েছে। একটি পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার আশপাশে বাণিজ্যিক ও পতিত প্লটের সংখ্যা ৭ লাখের মতো। আরেক হিসাবে দেখা যায়, সারাদেশে এমন বিক্রীত বাণিজ্যিক আবাসিক প্লটের সংখ্যা আরো ১০ লাখের ওপর। বিক্রির আগমুহূর্তেও এগুলো পুরোদস্তর কৃষিজমি ছিল। এখন ছোট খণ্ডের প্রাচীরে ঘেরা অকৃষি জমিতে পরিণত হয়েছে। সারাদেশে এখন পতিত আবাসিক প্লট রয়েছে প্রায় ১৭ লাখ। এই ১৭ লাখ প্লটের আনুমানিক আয়তন কমপক্ষে ৫ লাখ বিঘা জমি। মিডিয়াব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজের একটি প্রবন্ধে উপরোক্ত তথ্যসমূহ উঠে এসেছে। ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’-এর মাধ্যমে এসব খালি পড়ে থাকা প্লটে সাময়িকভাবে চাষাবাদ করা গেলে শহরের অলিতে-গলিতে নিরাপদ ও সতেজ সবজির সরবরাহ বাড়বে। এতে দামও কমবে।


নগর-কৃষির সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, তেমনি বাস্তবায়নে বেশকিছু চ্যালেঞ্জও আছে। আধুনিক নগর-কৃষি গড়ে তুলতে সুষ্ঠু নগর পরিকল্পনার অভাব, পৃষ্ঠপোষকতার ঘাটতি, নগর-কৃষি সম্পর্কে ধারণার অপ্রতুলতা, অত্যধিক উষ্ণতা ও অতিবৃষ্টির কারণে ছাদবাগানের ফসল নষ্ট হওয়া, অতি উচ্চ ভবনে ছাদকৃষি করতে বৈজ্ঞানিক ধারণার অভাব, ফ্ল্যাট বাড়িতে ছাদবাগান করতে অংশীদারত্বের জটিলতা বা অনেকের অনাগ্রহ, জৈব পদ্ধতিতে রোগবালই দমন, সেচ ব্যবস্থাপনা, বৃষ্টির পানি ধারণ করার যুতসই প্রযুক্তির অভাব এবং অতিরিক্ত উৎপাদনে এর ভ্যালু এডিশন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনের সীমাবদ্ধতা তো রয়েছেই। আশার কথা হলো, এসব বিষয়ে সরকারি সহায়তায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু বিশ^বিদ্যালয় কাজ করে যাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মেট্রোপলিটন কৃষি বিভাগও এ বিষয়ে নিরসলভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে, তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলাই যায়।


নগর-কৃষি পরিকল্পনা মাথায় রেখে ভবিষ্যৎ নগর পরিকল্পনা করা গেলে নিরাপদ ফসল উৎপাদন টেকসই হবে। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে বাসার ছাদ, ব্যালকনি, বারান্দা এবং ভবনের আনাচেকানাচে শাকসবজি, ফলসহ অন্যান্য ফসলের চাষ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। অল্প জায়গায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গরু-ছাগল পালন, উন্নত পদ্ধতিতে হাঁস-মুরগি পালন করা যেতে পারে। এগুলোর বাস্তবায়নের জন্য শহরের মানুষের জন্য বিনামূল্যে দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মিডিয়ার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধকরণ অনুষ্ঠান প্রচার করা যেতে পারে। সরকারি পর্যায়ে নগর-কৃষির ওপর মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা গেলে প্রতিটি অঞ্চল নিরাপদ খাদ্যনগরী তথা সবুজ নগরীতে পরিণত হবে। তবে, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে সততা ও দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই।


নগরের প্রতি ইঞ্চি ভূমি, মুক্ত আকাশ, সৌরশক্তি, মৌসুমি বৃষ্টি, মুক্ত হাওয়া ও শহরের বর্জ্যকে ‘রিসাইক্লিং’য়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করে, মানুষের সৃজনী শক্তি ও কৃষি প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে ও পরিবেশের সুরক্ষায় নগর-কৃষির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী, বাংলাদেশ কৃৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)