আমি নাদিয়া আফরীন। আমার ছোট উদ্যোগটির নাম দিয়েছি Noyli, শুনতে যদিও শব্দটি ইংলিশ শোনায় তবে এটি কিন্তু একটি পুরোদস্তুর বাংলা শব্দ। নয়লি অর্থ নব বা নতুন বা প্রথম। দেশিয় সকল ঐতিহ্যকে হাল ফ্যাশনের সঙ্গে মিলিয়ে আধুনিক রূপ দেয়ার একটি চেষ্টা থেকেই মূলত আমার যাত্রা শুরু করি এবং নামটাও সেই একই কারণে রাখা।
২০১৮ সালের শেষ দিকে মাত্র ১৫০০ টাকা পুঁজির বিনিময়ে পথ চলা শুরু হয় নয়লির। সেই থেকে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলছে আমার স্বপ্ন যাত্রা নয়লি। ছোট বেলা থেকেই দেশপ্রেম ব্যাপারটা মনে গেঁথে ছিল। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তার মেয়ে হওয়ার কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছে।
বিভিন্ন কৃষ্টিগুলো কাছ থেকে দেখতে পেয়েছি। ভালো লাগাটা সেই থেকেই শুরু। বড় হতে হতে ধীরে ধীরে দেখেছি আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের কুটির শিল্পগুলোর জরাজীর্ণ দশা। নায্য মজুরির অভাবে তারা তাদের পেশার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। সেখান থেকেই মূলত তাদের নিয়ে কাজ করার একটি বাসনা তৈরি হয়।
কৃষ্টি, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যে সমৃদ্ধিশালী জাতি আমরা। কিন্তু কিছু অপসংস্কৃতি এবং নিজস্বতার ঠিকমতো লালন পালন না করাতে আমরা যেন নিজেরাই নিজেদের হারিয়ে ফেলছি। তাই বিশ্বময় আমাদের প্রতিটি স্বাক্ষরিত সমস্ত পণ্যগুলো ছড়িয়ে দিতে চাই। স্বপ্ন দেখি আমাদের গার্মেন্ট আইটেম গুলোর মতো একদিন আমাদের খাদি, মসলিন, সিল্ক বস্ত্রগুলোও স্থান পাবে বিদেশিদের পড়নে। সেখানে থাকবে আমাদের দক্ষ কারিগরদের সুনিপুণ হাতের কাজ অথবা আঁকিয়েদের চিত্রকর্ম।
ইচ্ছে আছে চামড়া, মাটি, পাট, বেতসহ সকল ঐতিহ্য যা কিনা মিশে আছে বাঙালির রক্তে, সেসকল ঐতিহ্য একদিন রাজত্ব করবে পৃথিবীময়। সাথে হাজারো বছর বেঁচে থাকবে বিলুপ্ত প্রায় পেশাগুলো। কুমার, তাঁতি, সুঁচ্কর্মি, চিত্রশিল্পী, কুটির শিল্পের কর্মীরা। গ্রামীণ নারীরা ফিরে পাবে তাদের হারিয়া যাওয়া জীবন। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো হয় ওঠবে এক একটি স্মারক।
আমার এই পথ চলায় যারা সঙ্গ দিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। কিন্তু আরো দশ/বিশ জন নারীর মতো আমার এই পথটাও কণ্টকমুক্ত নয়। পারিবারিক বাঁধা, সহযোগিতার অভাব, সর্বোপরি বিনিয়োগের অভাব। সব মিলিয়ে প্রতিটি পদে আছে চোরাবালি তবুও সৃষ্টিকর্তার রহমত আর আত্মবিশ্বাসের ওপর ভর করে গত তিন বছরে তিল তিল করে নিজেকে দাঁড় করানোর যুদ্ধ করছি বা করতে পারছি।
ভেঙ্গে পড়িনি বা ভেঙে পড়ব না, এটাই নীতি। কাজের মাধ্যমেই জবাব দিয়েছি প্রতিটি অযাচিত প্রশ্নের। ছোট্ট হলেও আজ নয়লি একটি ব্র্যান্ড। যতটুকু পরিচিতি আছে ততটুকুতে সবাই জানে নয়লি মানে ভিন্ন কিছু, নয়লি মানে নতুন কিছু। এখানকার প্রতিটি পণ্য তৈরি হয় সম্পূর্ণ নিজস্ব তত্ত্বাবধানে। নিজস্ব চিন্তা ভাবনার ফসল।
প্রায় ৩০ জন কর্মীর ঘাম মিশে আছে নয়লির সাথে। তাদের সুখ দুঃখের গল্প জড়িয়ে আছে প্রতিটি পরতে। আমাদের বর্তমান সরকার যথেষ্ট পরিমাণে নারীবান্ধব। সেক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা তো আছেই। যদিও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার পথটা অনেক দীর্ঘ এবং কঠিন। ব্যাংক ঋণগুলোতে আছে উচ্চ সুদ এবং অনেক শর্ত। যেই শর্তসমূহ পার করে এই সুবিধা ভোগ করা বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে যায়।
তার ওপর পরিমাণটাও যথেষ্ট নয়। ব্যাংক ঋণ এবং প্রণোদনার পথটা আরেকটু মসৃণ হওয়া জরুরি বলে আমি মনে করি। আমি নিজেও এখন পর্যন্ত কোনো আর্থিক সহযোগিতা পাইনি ব্যাংক অথবা সরকারি তহবিল থেকে। চেষ্টা করেছি কিন্তু বন্ধকসহ অনেক শর্ত আরোপ করা হয়। তাই সেই পর্যন্ত আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টায় তাই নিজ উদ্যোমেই চলছি।
নয়লির পণ্য তালিকায় আপাতত আছে দেশিয় কাপড়ের তৈরি বিভিন্ন পোশাক, হতে তৈরি গহনা, ঘর সাজানোর সরঞ্জামাদি, চামড়াজাত পণ্য। গুণগত মন বজায় রাখার কারণে এবং যেহেতু আমাদের প্রতিটি পণ্য বাজারের পণ্য থেকে ভিন্ন এবং তাতে শৈল্পিকতা এবং নতুনত্ব আছে, তাই ক্রেতাগণের কাছে এর একটা চাহিদা আছে। আমার সব থেকে বড় অর্জন হলো, আমি এমন কিছু ক্রেতা তৈরি করতে পেরেছি যারা কিনা পূর্বে মনে করত খাদিতে আধুনিকতা নেই, আর আজ তারা রীতিমত খাদি ভক্ত।
অযথা তর্ক পছন্দ নয়, তাই সমালোচকদের মৌখিক জবাব দিতে যাই না। চলার পথে শুভাকাঙ্খিদের দোয়া আর ভালোবাসাটাকে পুঁজি করেছি। আগামীতেও সবার সহযোগিতা চাই। দেশকে বিশ্বের দরবারে নতুন রূপে তুলে ধরার এই প্রচষ্টায় হাতে হাত ধরে এগিয়ে যাব সবাই মিলে। আমরা বাঙালি, আমরা চাইলেই পারি।
নাদিয়া আফরীন
উদ্যোক্তা - নয়লি