নদীভাঙনের শিকার হয়ে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার একটি বস্তিতে বাস করছেন মিনারা বেগম। কাজ নেন বাসাবাড়িতে। এ ছাড়া হোটেলে ও ইট ভাঙার মতো কাজও করতে হয় জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে। কিন্তু শহরেও তার জীবন স্থায়ী নয়। তিনবার বস্তি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর তার সর্বশেষ ঠাঁই মেলে ঢাকার একটি রাস্তায়। এটাই তার এখন ঠিকানা। অথচ একদিন তার স্থায়ী ঘরবাড়ি ও ঠিকানা ছিল। তিনবার নদীভাঙনের কবলে পড়ে সব হারান তিনি।
এটা শুধু মিনারা বেগমের গল্প নয়, জলবায়ু পরিবর্তনে উদ্বাস্তুর শিকার হওয়া হাজারো মিনারার গল্প মোটামুটি একই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নারীরা অস্বাভাবিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাদের মানবেতর জীবনের পাশাপাশি মানসিক চাপ, নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের সহিংসতা এবং বাল্যবিয়ে বেড়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে সম্পর্কিত স্থানচ্যুতি ও অভিবাসনের কারণে নারীর ওপর পারিবারিক দায়িত্বের বোঝা বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন একটি স্বীকৃত বিষয়। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। এর প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় এবং নদীভাঙনের মতো দুর্যোগ বাড়ছে। যদিও গত ৫০ বছরে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ার কারণে ঘূর্ণিঝড়ে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা আগের চেয়ে কমে আসছে। কিন্তু বাস্তুচ্যুত মানুষের মিছিল কমেনি। এসব দুর্যোগের কবলে পড়ে জীবন-জীবিকা হারাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাস্তুচ্যুত এই মানুষগুলো শহরের বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।
দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেছেন, দেশে প্রতিবছর ৫০ হাজার লোক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে দুর্যোগ হয় তার কারণে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। যদিও সরকার এই বিপুলসংখ্যক লোককে আশ্রয়ের ব্যবস্থা এবং তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য অনেক পদক্ষেপ নিচ্ছে। এনজিওগুলোও কাজ করছে।
যদিও বিশ্বব্যাংকের হিসাব বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাসস্থান হারাবে। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর চার লাখ মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছে স্থায়ীভাবে। এই সংখ্যা প্রতিদিন ২ হাজারের মতো। তাদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ জলবায়ু উদ্বাস্তু।
সম্প্রতি অ্যাকশনএইড আয়োজিত নারীদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়টি ওঠে আসে। এতে বিশেষজ্ঞরা বলেন, নারীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর সমাজ, সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব নারীদের কাঁধে এসে পড়ছে। সহায়-সম্বল হারিয়ে তাদের ঠিকানা হচ্ছে রাজধানীর মতো বড় বড় শহরের ফুটপাত।
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইসিসিসিএডি) পরিচালক ড. সালেমুল হক এ বিষয়ে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নারীরা অস্বাভাবিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের অধ্যাপক ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. মাহবুবা নাসরীন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয় যখন কোনো সম্প্রদায়কে আঘাত করে, তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন নারীরা। গবেষণায় দেখা যায়, এ সময় নারীদের মানসিক চাপ বাড়ার পাশাপাশি নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের সহিংসতা, বাল্যবিয়ে বেড়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে নদীভাঙনে সবচেয়ে বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। এছাড়া সাইক্লোন, ঘূর্র্ণিঝড়, লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়ার কারণে মানুষের স্থানচ্যুতি বাড়ছে। ঘরবাড়ি, ভিটেমাটি হারিয়ে মানুষের আশ্রয় মিলছে নগরজীবনে। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সিলেটসহ দেশের সব ছোট-বড় শহরেই এই স্থানচ্যুত দরিদ্র মানুষের ভিড়। ফলে নগরে জনসংখ্যার ঘনত্ব ও চাপ বেড়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীর ঢাকায় জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বাড়ছে। যাদের বেশির ভাগই নদীভাঙনের শিকার। দেশের বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও জলবায়ু গবেষক ড. আতিক রহমান বলেন, শুধু গরিব মানুষ নন, ধনীরাও জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হচ্ছে। জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে মানুষ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।
জলবায়ু উদ্বাস্তুর শিকার হওয়া এমনই একজন কুলকুম বেগম। নদীভাঙনের শিকার হয়ে রাজধানীর বস্তিতে এখন তার ঠাঁই হয়েছে। তিনি বলেন, বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। বস্তিবাসীরা নানা দিক থেকেই বঞ্চিত। শিক্ষা নেই, চিকিৎসা নেই, থাকার জায়গা নেই। বর্জ্য নিয়েই তাদের বসবাস করতে হয়। এই শহরে এসে আমাদের পরিচয় হারিয়ে বস্তিবাসী পরিচয়টাই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বস্তিবাসী রাফেজা বলেন, বস্তিবাসীদের মৌলিক চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। তারা যুগের পর যুগ নিগৃহীত হয়েই থাকছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের নানা নেতিবাচক প্রভাবের ফলে নগরে এসেও তারা নানা দুর্ভোগ সামাল দিচ্ছেন। বর্ষা, গ্রীষ্ম ও শীতকালে জলাবদ্ধতা, তীব্র দাবদাহ ও শৈত্যপ্রবাহ সামাল দিতে হয় তাদের। ফলে তাদের রোজগার কমে যাচ্ছে। কর্মসংস্থানে সমস্যা, রোগবালাই বেড়ে যাওয়ায় এক অমানবিক পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে। এই জলবায়ু উদ্বাস্তু নগর দরিদ্রদের নেই কোনো স্থায়ী বসবাসের ঠিকানা। আবাসন ব্যয়ও অনেক বেশি।
নগর দরিদ্রদের নিয়ে বেসরকারি সংগঠন বারসিকের গবেষণায় উঠে এসেছে- ঢাকা শহরের অধিকাংশ বস্তি, সরকারি জায়গা এবং ভাসমান অবস্থায় ঠাঁই হচ্ছে উদ্বাস্তুদের। আবার বস্তিগুলোর অধিকাংশ নগরের প্রান্তিক এলাকায় নদী, খাল ও জলাভূমির কাছে অবস্থিত। ঢাকার অধিকাংশ বস্তির পরিবেশ অত্যন্ত দুর্গন্ধময়, অপরিচ্ছন্ন ও ঘিঞ্জি। সিটি করপোরেশনের সেবা এখানে তেমন একটি নেই। তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী যেভাবে স্থানচ্যুত হয়ে নগরে আসছে, নগরে যেভাবে নানাবিধ সংকট তৈরি হচ্ছে, সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলায় সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
এক্ষেত্রে নগর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সচেতনতা ও দক্ষতা বাড়ানো জরুরি। পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে নগর দরিদ্রদের আবাসন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কুটিরশিল্পভিত্তিক নিরাপদ কর্মসংস্থান, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণসহ উপযোগী অভিযোজন উদ্যোগগুলোকে সহায়তা করা জরুরি। আর এ কাজে স্থানীয় সরকার, প্রশাসন, গণমাধ্যম, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, বস্তিবাসীদের নিয়ে কর্মরত সংগঠন- সবার ঐক্য জরুরি।