বাংলা সাহিত্যে পাঠককে একসঙ্গে অনেকগুলো শক্তিশালী নারী চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘নষ্টনীড়’ গল্পে চারুলতা সুখী হওয়ার বাসনায় সামাজিকভাবে অস্বীকৃত সম্পর্কের বাঁধনে জড়িয়েছে। এতে আদর্শিক দ্বন্দ্ব থাকতে পারে, তবে আত্মপ্রবঞ্চনার গ্লানি একেবারেই নেই। ছোটগল্প ‘দেনা পাওনা’য় নিরুপমা চরিত্রটি তৎকালীন সমাজের সবচেয়ে ভীতিকর সামাজিক ব্যাধি ‘পণপ্রথা’র বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ‘চোখের বালি উপন্যাসে বিনোদিনী ভোগে-ভালোবাসায়, কোমলে-কঠিনে চিরাচরিত অবলা নারীর চরিত্রকে অস্বীকার করেছে অবলীলায়। শেষের কবিতার লাবণ্য বা গোরার সুচরিতার কথা তো বলাই যায়। এভাবেই নারীকে নিয়ে লিখেছেন বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য লেখকেরা।
বাংলা সাহিত্যে শুরু থেকেই বেশির ভাগ গল্প বা উপন্যাসের মূল বা প্রধান চরিত্রে থাকে নারী। শরৎ চন্দ্রের ‘মেঝ দিদি’ ‘পল্লীসমাজ’ এসব গ্রন্থের মূল চরিত্রে হচ্ছে নারী। নিমাই ভট্টাচার্যের ‘মেমসাহেব’ও নারীকে ঘিরে লেখা হয়েছে। সাহিত্যের এই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। এখনো যারা লিখছেন তারা নারীদের বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। বেশির ভাগ উপন্যাসে লেখার পটভূমিতে নারী চরিত্র দেখা যায়।
এর মূল কারণ হিসেবে লেখকরা বলছেন দক্ষিণ এশিয়ার অঞ্চলগুলো যেমন পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমারসহ অন্যান্য দেশে নারীরা বৈষম্যের শিকার বেশি। এজন্যই সাহিত্যে সব সময় নারীদের দুঃখ, কষ্ট এবং অভিমানের কথা ফুটে উঠছে।
‘স্বাধীনতার অনেকটা সময় পার করে আমি যখন স্বাধীন দেশের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করা সেই মহান বীরকন্যাদের খুঁজতে গেলাম তখন বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেছে। তাই সবাইকে আর খুঁজে পেলাম না, কারণ অনেকেই তখন তাদের আনা এই স্বাধীন দেশের ওই আকাশে তারা হয়ে গেছেন। তারপরেও যাদের সঙ্গে দেখা হলো, কথা হলো, তাদের জন্যও এই সম্মানজনক বীরাঙ্গনা শব্দটির ভুল ব্যাখ্যা আরো অনেক লজ্জার, অনেক কষ্টের।
‘তাদের মনে আজো অনেক অভিমান, অভিযোগ, অনুযোগ জমে আছে। আবার আমাদের সামনেই বীরাঙ্গনা হিসেবে ভাতা গ্রহণকে অসম্মানের বলতেও কারো কারো মুখে একটু আটকাচ্ছেনা, তাদের সঙ্গে এমন সব ব্যবহার করতে একটুও বাঁধছে না। অন্যদিকে বীরাঙ্গনাদের মাঝে কেউ কেউ ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, সেসময় অনেককেই তাদের মতো নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়েছে, জীবনের চরম মূল্য দিয়ে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।’
‘রণাঙ্গনে বীরাঙ্গনা’ গ্রন্থটিতে লেখক নাসিমা আক্তার জাহান তাদের অসামান্য অবদানের কথাই তুলে ধরেছেন। ‘পূর্বা’ প্রকাশনীতে বইটি এ বছর প্রকাশিত হয়েছে। ২৫ শতাংশ ছাড়ে বইটি বিক্রি হচ্ছে ২৬২ টাকায়।
এ বছরের মেলায় রয়েছে কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, সেলিনা হোসেন, সুরমা জাহিদ, নাসরিন জাহান, ঝর্ণা রহমান, শাহীন আখতার, শাহনাজ মুন্নী, আফসানা বেগম, রাশিদা সুলতানা, পাপড়ি রহমান, রুমা মোদক, রঞ্জনা বিশ্বাস, ফাতিমা জাহান, ইশরাত তানিয়া, স্মৃতি ভদ্র, নাহিদা আশরাফী, মাহফুজা হিলালী, সাধনা আহমেদসহ বিভিন্ন লেখকের নতুন বই। শুধু কবিতা, গল্প, উপন্যাস নয় প্রবন্ধ ও গবেষণামূলক গ্রন্থও লিখছেন অনেকে। লিখছেন ভ্রমণকাহিনি। বিচিত্র বিষয় নিয়ে লেখালেখি করছেন নারীরা। তাদের লেখার পরিধি ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে।
বইমেলায় এখন নারীদের অনেকেই অংশ নিচ্ছেন। শুধু লেখক হিসেবে নন, প্রকাশক হিসেবেও যাত্রা শুরু করেছেন তারা। কিন্তু নারীরা লেখক হিসেবে যত সাবলীলভাবে মনের ভাব প্রকাশ করছেন, প্রকাশকরা প্রকাশনার ক্ষেত্রে ততটা এগোননি।
শায়লা রহমান তিথি ‘ঝুমঝুমি’ প্রকাশনীর প্রকাশক। তিনি বলেন, প্রকাশনা সেক্টরে নারীরা কাজ করবেন- এই বিষয়টা এখনো অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। প্রকাশক হিসেবে ছেলেদের যতটা সহজে মেনে নিচ্ছে। আমি নারী প্রকাশক হয়ে তার অনেকটা ঘাটতি দেখেছি। অনেক সময় মানুষের তাকানো, কথা বলার পদ্ধতি এবং আমাদের কে আলাদা চোখে দেখাটা নিজের কাছে কিছুটা অস্বস্তি মনে হয়।
সব সেক্টরেই মেয়েদের মেনে নিতে পারছে না বিষয়টা কিছুটা হলেও এমন দেখায়। তবে আমাদের সমাজের এমন দৃষ্টিভঙ্গি পালটাতে হবে। তবে এখন নারী প্রকাশক অনেক আছেন। সব নারী প্রকাশক যদি এক হয়ে ভালোভাবে কাজ করি তাহলে আমরা এ ধরনের চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে পারব।
‘পাঞ্জেরি’ প্রকাশনীর বক্রয় প্রতিনিধি মুন্নী আক্তার মিতা নারি দিবসে তার ভাবনার কথা তুলে ধরেন ভোরের আকাশের কাছে। তিনি বলেন, চলার পথে নারীদের সুবিধা অসুবিধা সব কিছুই মোকাবিলা করতে হয়। তবে আগে থেকে নারীরা তুলনামূলক এগিয়ে। আমাদের নারীদের জন্য সব থেকে বড় আইডল হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কারণ তিনি একজন নারী। তিনি যেহেতু নারী হয়ে এত কিছু করতে পারছেন আমরাও তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের প্রতিযোগিতার জায়গায় নিয়ে যেতে পারব। আর এমন একটা সময় আসবে যখন নারীদের আর আলাদা করে দেখা হবে না।