সংকট পিছু ছাড়ছে না ন্যাশনাল ব্যাংকের। করোনার মধ্যে বিশেষ সুবিধা, খেলাপি ঋণ প্রকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা গ্রহণের পরও খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তার প্রতিঘাত প্রভিশন ঘাটতিতে বেসামাল অবস্থা ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
বাণিজ্যিক ন্যাশনাল ব্যাংকটির বর্তমান খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৯৫৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যা বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে সর্বোচ্চ। ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশই খেলাপি।
করোনা মহামারির প্রথম বছরে ঋণের কিস্তি না দিলেও খেলাপি হবে না। পরের বছর ১৫ শতাংশ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রেখে নির্দেশনা জারি করলেও সুবিধা অব্যাহত রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ আনুকূল্যও পায় ব্যাংকটি। তারপরও দুই বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ১৭৯ কোটি ২২ লাখ টাকা।
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭৭৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা। সে সময় ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৩৫ হাজার ৪৫৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ। দুই বছর পর ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা। যা ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। করোনার অভিঘাত বিপর্যন্ত সময়ে এসে ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ২৯০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
প্রভিশন হলো খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি, যা গ্রাহকের আমানতের রক্ষাকবজ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তিন ধরনের খেলাপি ঋণ হলো, যথাক্রমে সাবস্ট্যান্ডার্ড (এসএস) বা প্রাথমিক মানের খেলাপি ঋণ, ডাউটফুল (ডিএফ) বা মধ্যমমানের খেলাপি ঋণ এবং ব্যাড অ্যান্ড লস (বিএল) বা মন্দমানের খেলাপি ঋণ। এই তিন ধরনের খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে যথাক্রমে ২৫ ভাগ, ৫০ ভাগ ও ১০০ ভাগ পর্যন্ত প্রভিশন বা সঞ্চিতি রক্ষা করতে হয়। এ সঞ্চিতি বা প্রভিশন আমানতের বিপরীতে গ্রাহকের রক্ষাকবজ হিসেবেও বিবেচনা করা হয় এবং ব্যাংকগুলোর মুনাফা থেকে সংরক্ষণ করতে হয়।
মুনাফা না থাকলে সেই ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি হিসাবে দেখানো হয়। যে ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে সে ব্যাংক মুনাফা করতে পারছে না, সমস্যায় বলে মনে করা হয়। করোনাকালে ব্যাংকটির শুধু খেলাপি ঋণই বৃদ্ধি পায়নি, নিট মুনাফার ক্ষেত্রেও বড় ধরনের ধস নেমেছে। দুই বছরে উল্লেখযোগ্য মুনাফার মুখ দেখেনি। মুনাফা না হওয়ার কারণে খেলাপি ঋণের বিপরীতে মুনাফা থেকে যে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয় তা সংরক্ষণ করতে পারেনি। ফলে প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে গেছে অসম্ভব হারে।
ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে ন্যাশনাল ব্যাংক। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কারণ দর্শনোর নোটিশ দেওয়া হয়। অনিয়ম থেকে ক্ষমা চেয়ে চিঠিও দেওয়া হয় ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, আইন অমান্য করে ব্যাংকের পরিচালক এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে নজিরবিহীন পরিমাণ ঋণ দেয়। ব্যাংকিং আইনের গুরুতর লঙ্ঘন করে ন্যাশনাল ব্যাংক তাদের ২ পরিচালক রিক হক সিকদার ও রন হক সিকদার এবং তাদের পরিবারের সদস্যসহ মোট ১১ জনকে ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে ১৩ দশমিক ৬৩ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ১১৮ কোটি টাকা) খরচ করার সুবিধা দেয়। একইসঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংক তাদের কার্ড বিভাগকে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে পরিচালনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে যেন তাদের কার্ড সেবা বন্ধ করে না দেওয়া হয়।