logo
আপডেট : ১০ মার্চ, ২০২২ ০১:০৫
পরিশ্রম সৌভাগ্যের চাবিকাঠি
সোনিয়া সিমরান

পরিশ্রম সৌভাগ্যের চাবিকাঠি

উদ্যোক্তা কাফিয়া হোসেন

আমি ‘কাফিয়া হোসেন’ এই মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী। আমার জন্মস্থান ফরিদপুর। আমার বেড়ে ওঠা ঢাকা শহরে। বাবা বিমানবাহিনীর একজন রিটায়ার্ড পারসন। আর আমার মা একজন গৃহিণী। আমি মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মেয়ে। আমরা দুই বোন এক ভাই। ভাই-বোনের মধ্যে আমি সবার বড়। আমার মা, যিনি আমার দেখা পরিশ্রমী মানুষদের মধ্যে অন্যতম। তার প্রতিভার কোনো কমতি ছিল না।

তবুও পরিবার থেকে উনাকে কখনই কোনো প্রকার সহায়তা করা হয়নি, সব সময় তাকে বোঝানো হয়েছে যে উনাকে হাউস ওয়াইফ হিসেবেই থাকতে হবে; কখনই বাইরে জব করা যাবে না। কিন্তু আমার অনুপ্রেরণার মূলেই ছিলেন আমার মা।
ছোটবেলা থেকে আমার মাথায় একটা চিন্তা কাজ করত আমাকে কিছু একটা করতে হবে, আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে- যেহেতু আমার মায়ের প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও উনি কিছু করতে পারেনি; তাই আমার মা মনেপ্রাণে চাইতেন তার ছেলেমেয়েরা ভালো কিছু করুক, নিজের পায়ে দাঁড়াক।

আমি এসএসসি এবং ইন্টার পাস করেছি বিএফ শাহীন কলেজ থেকে। তারপর অনার্স-মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি ইডেন মহিলা কলেজ থেকে। পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন কালচারাল প্রোগ্রামের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম। যেমন বিতর্ক প্রতিযোগিতা, কবিতা আবৃত্তি। আসলে এক রকম ভালোলাগা থেকেই এ কাজগুলো করা।

সবকিছু করার পাশাপাশি সব সময় একটা জিনিস খুব ভাবাত আমাকে যে- আমাকে উপার্জন করতে হবে। আর সেই ভাবনা বাস্তবে আসতে দেরি হয়নি। অনার্স ফার্স্ট ইয়ারেই একটা কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষিকা হিসেবে জয়েন করি। পাশাপাশি বাসায়ও কিছু ছেলেমেয়েকে পড়ানো শুরু করি।


তো এভাবেই আমার প্রথম উপার্জনের শুরু। যদিও পরে আরো তিনটা কোম্পানিতে জব করার সুযোগ হয়। আমি কখনই থেমে থাকিনি, পড়ালেখার পাশাপাশি কিছু না কিছু আর্নিং করেই গেছি। আর যেহেতু আমি মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির একজন মেয়ে, অবশ্যই আমার ফ্যামিলি অনেক বেশি সচ্ছল ছিল না। সব সময় একটা-না-একটা চাহিদার কমতি যেন থেকেই যেত।

যদিও আমার বাবা সেটা যথাসাধ্য পূরণ করার চেষ্টা করতেন। তারপরও আমার মা এবং ছোট দুই ভাইবোনের কথা চিন্তা করে আমার সব সময়ই মনে হয়েছে যে আমাকে নিজে কিছু একটা করতেই হবে। আমার বন্ধু যারা ছিল, ওরা সব সময় একটা কথা বলত যে- তুই পড়ালেখা কর, চাকরি পরে অনেক করতে পারবি। কিন্তু আমার চিন্তাধারা ছিল অন্যরকম। আমার বাবা একটা পুরো ফ্যামিলি চালাতেন।

তার হেল্পিং হ্যান্ড কেউ ছিল না তখন। আমি অল্পস্বল্প যাই করি তাই তো আমার ফ্যামিলিতে কাজে লাগবে। হ্যাঁ, আমি একজন মেয়ে কিন্তু আমি কি পারি না আমার বাবার ছেলে হিসেবে কিছু করতে। হ্যাঁ, আমি নারী, আমিও পারি।
আমার চেষ্টা চালিয়ে যাই। বাধাগ্রস্ত হলেও আমি কখনই কোনোদিন পিছুপা হয়নি।

২০১৭ সালে আমি মাস্টার্স কমপ্লিট করি। তারপর কিছুদিন ঘরে বসে থাকা। তখনই কুকাপ নামে একটা প্ল্যাটফর্ম ফেসবুকের মাধ্যমে আমি দেখি এবং আমার মাকে বললাম, চলো আমরা রান্না নিয়ে কিছু করি। যেহেতু আমার মা খুব ভালো একজন রাঁধুনি, যেটা না বললেই নয়। তারপর কুকাপের সঙ্গে ওদের শেফ হয়ে কাজ করা।

হ্যাঁ, আমি জানি আমি চাইলে ভালো একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে অথবা ব্যাংকে জব করতে পারতাম। কিন্তু কেন যেন এই রান্না করাটা আমার অনেক ভালো লাগাতে পরিণত হলো এবং টুকটাক কাজ করতে লাগলাম। ২০১৮ সালে আমার বেবি হয়। বেবি হওয়ায় ওকে আমার অনেক সময় দিতে হতো। আমার নিজের জন্য কোনো সময় আমি বের করতে পারতাম না।

আমি খুব হতাশ হয়ে যাচ্ছিলাম বাসায় থাকতে থাকতে। এই সময়ে আমি কুকাপের সঙ্গে। আমার তেমন কাজ করা হচ্ছিল না। আসলে আমি সময় করে উঠতে পারছিলাম না একদিকে সংসার; আরেকদিকে ছোট বেবি। ফেসবুকের বদৌলতে শপআপের সঙ্গে আমার কমিউনিকেশন শুরু হলো। ওরা আমার সঙ্গে কমিউনিকেট করল।

আমাকে অফার করল ওদের উদ্যোক্তা হিসেবে জয়েন করার জন্য। ওদের সঙ্গে কাজ শুরু করি। আমার নিজের একটা পেজ ওপেন করা হলো, যার নাম কাফিআস কালেকশন। ওদের প্রস্তাবে আমি অরজিনাল পাকিস্তানি ড্রেস নিয়ে কাজ শুরু করলাম। আলহামদুলিল্লাহ আমি অনেক ভালো ফিডব্যাক পেয়েছি।

কাস্টমার থেকে আমার কালেকশনের অনেক ভালো রিভিউ পেয়েছি। পাশাপাশি কুকাপের সঙ্গে কাজ করছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালোই রেসপন্স পাচ্ছিলাম কুকাপ থেকে। আমি সব সময়ই চেয়েছি আমার ফুড এবং আমার নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে। ২০২০ সালে আমার ছোট ভাই আমাকে বলল, তুমি একটা পেজ ওপেন করো ফুডের।

তোমার খাবারগুলো অনেক ক্রিয়েটিভ, ভালো সাড়া পেতে পারো। তার ইন্সপায়ারসানে আমার ‘ডেজার্ট স্টোরিজ’ এবং নিঞ্জা শেফ’স ক্যাটারিং ওপেন করা। আমি নিজেও একজন ডেজার্ট লাভার এবং কুক লাভার। এই ভালোবাসাটাই এক সময় নেশা এবং পেশাতে পরিণত হয়ে গেল। ফুড নিয়ে আমার কাজ করা শুরু হলো পুরোদমে। আমি চেয়েছি প্রফেশনাল শেফ হতে, নিজেকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে।

ডিফারেন্ট টাইপস ডেজার্ট মেকিং অ্যান্ড কুকিং আমার ওয়ান অব দ্য পেসন্স। ‘ডেজার্ট স্টোরিজ’-এর সিগনেচার ডেজার্ট বিস্কুটি ডিলাইট আমার নিজের রেসিপি। ২০২০ সালের শেষদিকে ‘টনি খান কালিনারি ইনস্টিটিউট’ থেকে প্রফেশনাল পেস্ট্রি অ্যান্ড বেকারির একটা কোর্স কমপ্লিট করি।

তারপর ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের অধীনে ‘ডিপ্লোমা ইন কালিনারি আর্টস অ্যান্ড ক্যাটারিং ম্যানেজমেন্টে’ অ্যাডমিশন নিয়ে এখন স্টাডি করছি। আমার কাছে মনে হয় জানার এবং শেখার কোনো বয়সসীমা এবং সময়সীমা নেই। আমি নিজে একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছি একাডেমি অব কালিনারি আর্টস।

সেই প্ল্যাটফর্মে নতুন যারা উদ্যোক্তা হতে চায়- পুরুষ এবং মহিলা উভয়ই জয়েন করতে পারবে। যারা ফুড নিয়ে কাজ করতে চায়, কিন্তু আর্থিক সার্মথ্য এবং ফ্যামিলির সাপোর্ট না থাকার কারণে পারছে না। তাদের নিয়ে আমার কিছু করার চেষ্টা এবং সেই চেষ্টা থেকেই ওপেন করা। বর্তমানে এটা নিয়ে ভালোভাবে কাজ শুরু করে দিয়েছি।

আশা করছি, আপনারা সবাই আমাদের অনেক সহযোগিতা করবেনÑ যারা এই সেক্টরে আসতে চাচ্ছেন। আমাদের এই কালিনারি একাডেমিতে আরো নতুন অনেক টিচার্স জয়েন করবেন ইনশাআল্লাহ। যাদের থেকে আশা করছি আপনারা অনেক কিছু শিখতে পারবেন। সর্বোপরি, আমরা কথায় নয়Ñ আমরা কাজে বিশ্বাসী। এই চিন্তাধারা নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।


প্রতিনিয়তই আমি সমাজব্যবস্থা এবং পারিপাশির্^ক সবকিছু নিয়ে অনেক বাধার সম্মুখীন হচ্ছি। কিন্তু আমি থেমে নেই। আমি আমার কাজগুলোকে ভালোবেসে ধৈর্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে এগিয়ে যাচ্ছি। আর এভাবেই আমি এগিয়ে যেতে চাই। সঙ্গে আমার শুভাকাক্সক্ষীদের এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। যেতে চাই অনেক দূর। সবাই দোয়া করবেন আমার জন্য।


নিচের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে অনলাইন সার্ভিসের মাধ্যমে সেবা দিয়ে আসছি। তবে খুব শিগগিরই প্রতিটি সার্ভিসের জন্য শপ খোলা হবে।

কাফিয়া হোসেন
উদ্যোক্তা- কাফিয়াস কালেকশন
ফাউন্ডার অ্যান্ড শেফ- ডেজার্ট স্টোরিজ
সিইও- একাডেমি অব কালিনারি আর্টস এবং নিঞ্জা শেফ’স ক্যাটারিং