মানুষ হওয়ার চেষ্টা করলেও আমি যে নারী তা মনে করার মতো পারিপাশির্^কতার ভেতর আমার বসবাস। কারণে-অকারণে নারী হয়ে উঠেছি। সেই কারণে মানুষ হওয়ার আক্ষেপ থেকেই গেল। এই কথা বলার পর নারীবাদী বলে রেখে দিতে পারেন সমাজের আলাদা এক বর্গে। সেই বর্গে অনেক নারীই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে নিজেকে মানুষ দাবি করে এবং নারীকে মানুষ ভাবার স্বপ্ন নিয়ে যারা এগিয়ে আসতে চায়।
তাদের উদ্দেশ্য মূলত নিজের অধিকারের লড়াইয়ের পথ তৈরি করা। গুজগুজ ফিসফিস করতে করতে ফুসফুস ফুলিয়ে আঙুল নাড়িয়ে কটাক্ষ করতে পারে এই সমাজ। এই যে আঙুল তুলে আমিটাকে তৈরি করতে এত কাঁটায় ভরা পথ দেখছি। আমি ভাবছি এই পথ থেকে কাঁটা ফুটিয়ে পা রক্ত শীতল হোক আমার। নরকের আগুনে পুড়িয়ে পাপাচারী নাম লিখতে আমার ভয় নেই।
যদিও-বা আমার ভাবনায় ভয়কে জয় করা কোনো পাপ নয়। আমার ভাবনাই আমার রাস্তা। ভোর হতেই যে পথে আমারা পা বাড়িয়ে দেই। সমস্ত ক্লান্তিতে বিছিয়ে দেই নিজেকে। হ্যাঁ, এই অনুভূতিটাই নিজের। সেখানে লিঙ্গের নয়, মানুষ শব্দটাই আমি উচ্চারণ করছি।
নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার প্রধান সামাজিক কৌশলগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে নারীদের পুরুষের তুলনায় অধীনস্থ অবস্থানে রাখার জোরপূর্বক প্রচেষ্টা চালানো। আর এসব কারণে নারী সমাজ ও রাষ্ট্রের দ্বারা সহিংসতার শিকার। এমনকি প্রতি পদে পদে একজন নারীকে মানসিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়।
কর্মক্ষেত্রে কোনো নারী তার নিজ যোগ্যতাগুণে এগিয়ে গেল কিংবা প্রমোশন পেলে নানা গুঞ্জন তৈরি হয়। অবশ্য এমন গুঞ্জন তৈরিতে নারী সহকর্মীদের অনেক সময় এগিয়ে থাকতে দেখা যায়। প্রতিহিংসাই এর প্রধান কারণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। আর এই প্রতিহিংসা কাজের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। যার ফলে প্রতিহিংসাই নারীর প্রতি নারী সহিংসতায় রূপ নেয়।
এ সব অসুস্থ মানসিকতায় অফুরান সম্ভাবনা হারিয়ে যাওয়া নারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। নীতিগতভাবে আমাদের নারীদের প্রতিহিংসাকে না বলা উচিত এবং তার সঙ্গে নারীর প্রতি মানবিক শ্রদ্ধাবোধ থাকা প্রয়োজন। সেই জন্য নারীকে মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটেও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন ৮২ শতাংশ নারী।
কিন্তু মানসিক নির্যাতন কাকে বলা যাবে আর কাকে বলা যাবে না, এই বিষয়টি এখনো সামাজিক ব্যবস্থাপনার কাছে স্পষ্ট নয়। আর তাই সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার নারীরা মানসিকভাবে সুস্থ নয়। যেহেতু মানসিক নির্যাতনের খালি চোখে দেখা যায় না সেই অর্থে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দেওয়া সম্ভব নয়। প্রমাণ ছাড়া আইনের সুবিধাগুলোও নারী পাচ্ছে না।
সে কারণেই পারিবারিকভাবেও নারীর মানসিক নির্যাতন বেড়েই চলেছে। জীবনযাত্রার ধরন ও চাহিদার পরিবর্তন হলেও নারীর প্রতি চাপিয়ে দেওয়া মনোভাব এখনো ধর্ম ও কুসংস্কারের দোহাই দিয়ে টিকে আছে। এ পর্যায়ে নারীর পোশাকের কথা যদি ভাবি, তা হলে নারীর পোশাকের ইচ্ছাকে অসম্মান বা কটূক্তি করা মানবিক দিক বিবেচনা করলে দেখা যায় নারী বৈষম্য শিকার।
প্রচণ্ড গরমেও নারী তার পোশাকের ভাবনাকে একটা কমফোর্ট জোনে নিয়ে আসতে পারে এমন নারীর সংখ্যা খুব কম। গৎ বাঁধা নিয়মের বাইরে এসে বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি করতে হবে নারীদের। পরিবর্তনশীল সময়ে সঙ্গে সঙ্গে মানসিকভাবে সুস্থ থেকে নিজেকে নিয়ে ভাববার নতুন নতুন পথ তৈরি করা খুব প্রয়োজন।
সেটা একজন নারীর জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নারী একটা সুন্দর পৃথিবী, সমাজ তখনই সুস্থ পৃথিবীর স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে যখন এই সমাজের নারীরা মানসিকভাবে সুস্থ থাকবে। হাপিত্যেশ না করে এগিয়ে আসতে হবে নারীদের আর নারী হয়ে ওঠার চেয়েও মানুষ হয়ে উঠতে হবে প্রতিনিয়ত। এই ‘নারী দিবসে’ মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমিয়ে সুস্থ পথচলা হোক আমাদের প্রতিপাদ্য।