বহুল আলোচিত চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা হিসেবে পরিচিত (বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা অস্ত্র চোরাচালান মামলা) জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি রায় দেন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১) আদালত। এর কয়েক দিন পর এ রায় (ডেথ রেফারেন্স) অনুমোদনের জন্য ওই বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে পাঠানো হয়। এছাড়া কারাবন্দি আসামিরা আপিল করেন। এরপর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মামলার পেপারবুক তৈরি করা হয়। দ্রুত পেপারবুক তৈরি করা হলেও এই মামলাটি এখনো হাইকোর্টে বিচারাধীন। শুধু এই একটি মামলা নয়, বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৮শ ‘ডেথ রেফারেন্স’ মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, নিম্ন আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সাজা অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টে পাঠানো ‘ডেথ রেফারেন্স’ মামলার জট বাড়ছেই। আর সাত বছর আগেও এ ধরনের মামলা ছিল ৪শ’র নিচে। ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য হাইকোর্ট বিভাগে পর্যাপ্তসংখ্যক আদালত (বেঞ্চ) না থাকায় একদিকে ফাঁসির মামলা বাড়ছে। স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত এ ধরনের মামলার স্তূপ না কমায় দিন দিন বাড়ছে কনডেম সেলে বন্দির সংখ্যা। ফলে কারাগারে কনডেম সেলে অপেক্ষার প্রহর গুনে দিন কাটছে ফাঁসির আসামিদের। বর্তমানে কারাগারে বন্দি ফাঁসির আসামির সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়েছে বলে জানা গেছে। হাইকোর্টে ফাঁসির মামলার বিচার দীর্ঘায়িত হওয়ার পেছনে শুনানির জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক বেঞ্চ না থাকাই প্রধান কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এমন পরিস্থিতিতে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তিতে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ১১টি বেঞ্চ গঠন করেছেন। আগামী ২০ মার্চ থেকে এসব বেঞ্চ বসবেন। তথ্যানুযায়ী এর আগে ২০১৮ সালে ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তিতে হাইকোর্টে একসঙ্গে সর্বোচ্চ ৫টি বেঞ্চ গঠন করা হয়েছিল। এ কারণেই একসঙ্গে ১১টি বেঞ্চ গঠন করাকে যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলছেন সুপ্রিম কোর্টে ফাঁসির মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীরা।
কোনো মামলায় নিম্ন আদালত (জেলা ও দায়রা জজ আদালত) থেকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ড হাইকোর্টের অনুমোদন ছাড়া কার্যকর করার সুযোগ নেই। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা অনুযায়ী হাইকোর্টের অনুমোদন নিয়ে মৃত্যুদণ্ডের সাজা কার্যকর করতে হয়। এ কারণে আইন অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে এমন মামলার নথিপত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয় হাইকোর্টে, যা ডেথ রেফারেন্স হিসেবে পরিচিত।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন ডেথ রেফারেন্সের সংখ্যা ছিল ৮৩১টি। গত দুই মাসে এ সংখ্যা বেড়েছে। এখন এ সংখ্যা প্রায় সাড়ে আটশ। এর মধ্যে এখন বেশ কছু মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন। আর নতুন করে ৫৬টি মামলা বিচারের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে মঙ্গলবার বিভিন্ন বেঞ্চে পাঠানো হয়েছে ৫টি মামলা। আর ৫১টি মামলা নতুন গঠিত ১১টি বেঞ্চে পাঠানো হবে বলে জানা গেছে। আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে এই বেঞ্চের সংখ্যা ছিল চারটি। হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্সের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় এই মামলার শুনানির জন্য বেঞ্চের সংখ্যা বাড়িয়ে ৫টি করা হয়। ফলে মামলার বিচারে গতি আসে। কিন্তু ২০১৯ সালে বেঞ্চের সংখ্যা কমিয়ে করা হয় ৩টি। ফলে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্সের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের শুরুতে ডেথ রেফারেন্সের সংখ্যা ছিল ৪৫০টি। ওই বছর বছর শেষে দাঁড়ায় ৪০৬টি। ২০১৪ সালে বিচারাধীন ছিল ৩৬৩টি। ২০১৫ সালে ৪১৯টি, ২০১৬ সালে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৩৫টি। ২০১৭ সালে হয় ৬৪০টি। ২০১৮ সালে দাঁড়ায় ৭১১টি। ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী বিচারাধীন ডেথ রেফারেন্সের সংখ্যা ৭৭৫টি। কারাগার সূত্রে জানা গেছে, ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগার মিলে সারাদেশে সর্বমোট ৬৮টি কারাগারে গত বছর পহেলা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফাঁসির আসামি ছিল ২০০৫ জন।
হাইকোর্ট বিভাগে ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য বেঞ্চের সংখ্যা বাড়ানো প্রসঙ্গে রাষ্ট্রে প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিনউদ্দিন ভোরের আকাশকে বলেন, বেঞ্চ গঠন করার সম্পূর্ণ এখতিয়ার প্রধান বিচারপতির। প্রধান বিচারপতি তার প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য ১১টি বেঞ্চ গঠন করেছেন। প্রধান বিচারপতির এই সিদ্ধান্ত অসম্ভব রকম একটি ভালো পদক্ষেপ। প্রধান বিচারপতির এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। তিনি বলেন, হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স (ফাঁসির মামলা) ঝুলে থাকলে ওই সব মামলার আসামি যারা কারাগারে বন্দি আছেন, তাদের (আসামি) ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হয়। একইসঙ্গে বিচারপ্রার্থীরাও (বাদীপক্ষ) ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। তিনি বলেন, নিম্ন আদালতে যত আসামির ফাঁসির সাজা হয়, তা থেকে কিছু কিছু আসামি আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারে খালাস পায়। যেসব আসামি খালাস পায় তাদের বিনা বিচারে দীর্ঘদিন কনডেম সেলে বন্দি তাকাটাই ন্যায়বিচার পরিপন্থি। একইসঙ্গে যাদের নিকটাত্মীয় হত্যার ঘটনায় মামলা হয়, বিচার বিলম্বিত হওয়ার কারণে তারাও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। প্রধান বিচারপতি বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরে ১১টি বেঞ্চ গঠন করেছেন বলেই মনে করি। তিনি বলেন, যত দ্রুত ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হবে তত দ্রুতই আসামিপক্ষ বা বাদীপক্ষ ন্যায়বিচার পাবেন।
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মুনসুরুল হক চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন, কনডেম সেলে যেসব মানুষ বন্দি থাকেন তারা কেমন অবস্থায় থাকেন তা সবারই জানা। সেটা কোনোভাবেই সুখকর নয়। তিনি বলেন, ডেথ রেফারেন্স প্রধান বিচারপতি ১১টি বেঞ্চ গঠন করেছেন। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। তিনি বলেন, আমরা যারা আইনজীবী হিসেবে ফাঁসির মামলা পরিচালনা করি তাদের জন্য কষ্টকর হলেও আসামি ও বাদীপক্ষের জন্য এটা ভালো খবর। তিনি বলেন, এমনও দেখা যায়, ১৫-২০ বছর কনডেম সেলে থাকার পর আসামি খালাস পাচ্ছে বা সাজা কমছে। এক আসামি দীর্ঘদিন কনডেম সেলে থাকাটা কতটা অমানবিক তা চিন্তা করতে হবে। তিনি বলেন, বেঞ্চের সংখ্যা যত বাড়বে, মামলা তত বেশি সংখ্যায় নিষ্পত্তি হবে।
ফাঁসির আসামিদের মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আসামিদের কনডেম সেলে যাতে রাখা না হয় সে রকম নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদনকারী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন, প্রধান বিচারপতির এই সিদ্ধান্ত একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। তিনি বলেন, হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য শুধুই অবকাশকালে বেঞ্চ সংখ্যা বাড়ালে হবে না। ফাঁসির আসামিদের দুর্দশার কথা চিন্তা করে সারা বছরই যাতে এটা থাকে সেজন্য প্রধান বিচারপতির কাছে প্রত্যাশা থাকবে।
সংশ্লিষ্ট শাখা সূত্র জানায়, ডেথ রেফারেন্স শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) তৈরি করতে হয়, যেখানে মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র, সাক্ষীদের বক্তব্য ও বিচারিক আদালতের রায়সহ মামলার তথ্যাদি সন্নিবেশিত থাকে। সবকিছু পাঠানো হয় সরকারি ছাপাখানায় (বিজি প্রেস)। সেখান থেকে একটি বই আকারে প্রস্তুত হয়ে পেপারবুক হিসেবে আসার পর বিচারের জন্য পাঠানো হয় হাইকোর্ট বেঞ্চে। ডেথ রেফারেন্স বছরের পর বছর ঝুলে থাকার অন্যতম কারণ শুনানি পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পেপারবুক তৈরিতে দেরি হওয়া। একই সঙ্গে মামলা অনুপাতে ডেথ রেফারেন্স বেঞ্চের অভাব আছে। কোনো ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তিতে চার-পাঁচ বছর সময় লাগে।
কোনো মামলায় চূড়ান্ত বিচারে মৃত্যুদণ্ড বহাল না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে কারাগারে কনডেম সেলে রাখার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে গত বছর হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়। এই রিট আবেদন এখন শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। চট্টগ্রাম কারাগারে কনডেম সেলে থাকা সাতকানিয়ার জিল্লুর রহমান, সিলেট কারাগারে থাকা সুনামগঞ্জের আব্দুল বশির ও কুমিল্লা কারাগারে থাকা খাগড়াছড়ির শাহ আলমের পক্ষে এ রিট আবেদন দাখিল করা হয়। রিট আবেদনে মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে কনডেম সেলে বন্দি রাখা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না-এই মর্মে রুল জারির আর্জি জানানো হয়েছে। এ রুল বিবেচনাধীন থাকাবস্থায় আবেদনকারীদের কনডেম সেল থেকে স্বাভাবিক সেলে স্থানান্তরের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে দেশের সকল কারাগারের কনডেম সেলে থাকা সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের রাখার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে (সুযোগ-সুবিধা) কারা মহাপরিদর্শককে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।