logo
আপডেট : ১০ মার্চ, ২০২২ ১০:৩৬
নারী: অদম্য এক জাগ্রত শক্তি
নিজস্ব প্রতিবেদক

নারী: অদম্য এক জাগ্রত শক্তি

নারী বোঝা নয়, বরং শক্তি

১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্ক শহরের সুতা তৈরির কারখানায় দৈনিক ৮ কর্ম ঘণ্টাসহ ন্যায্য মজুরি ও অন্যান্য দাবি আদায়ের জন্য যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাকে ১৯১০ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে জার্মান সমাজতাত্ত্বিক ও সমাজতন্ত্রের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি ক্লারা জেটকিন নারীর ভোটাধিকার ও নারী দিবসের দাবিতে জোরদার আন্দোলনে রূপ দেন। মাঝখানে অনেক চড়াই-উতরাই পেরোনোর পর ১৯১৩ সালে মতান্তরে ১৯১৪ সালে রাশিয়ায় নারীরা ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ রোববার ‘নারী দিবস’ পালন করে আসছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিকভাবে ৮ মার্চকে বিশ্ব নারী দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়, যা অদ্যাবধি পালিত হয়ে আসছে।


অনেক চড়াই-উতরাই পেরোনো নারী দিবস আজকের দিনে পালনে ভিন্ন মাত্রা পেলেও তাতে আমাদের নারীদের অবস্থার উন্নয়ন কতটুকু হয়েছে তা ভেবে দেখার সময় হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ যা ‘সিডও’ নামে পরিচিত তার কথা বলতে হয়। এটি নারী অধিকারের একটি পূর্ণাঙ্গ দলিল যাতে বাংলাদেশসহ ১৩২টি দেশ স্বাক্ষর করেছে। সনদে যে ৩০টি ধারা আছে তাতে ৩ থেকে ১৬ পর্যন্ত ধারায় নারীর প্রতি বৈষম্য সংক্রান্ত দিকগুলো বর্ণিত হয়েছে আর বাকি ধারাগুলোতে এ বিষয়ক দায়িত্ব ও কর্মপন্থা বর্ণনা করা হয়েছে। পাশাপাশি ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২৫ নভেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য ঘোষণা করে, যা ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ হিসেবে পালন করা হয়।


প্রকৃতপক্ষে দিবস পালনের সার্থকতা তখনই আসবে যখন দিবসটি যে উদ্দেশে তৈরি করা হয়েছিল সেই উদ্দেশ্যটি যদি পূরণ হয়। আমরা যারা ঘরে বাইরে এখনো নারীকে শুধু উৎপাদনকারী হিসেবে বর্ণনা করি বা চিন্তা করি তাদের চোখে নারী আজো শুধুই নারীই, মানুষ হতে পারেনি। সন্তান উৎপাদন নারীকে মা হওয়ার চরম সার্থকতা দেয়, যা অতুলনীয় কিন্তু পাশাপাশি তাকে আরো অনেক দায়িত্ব পালন করে যেতে হয় যা তাকে কেউ বলে দেয় না, কিন্তু সে নিজের বোধ থেকে তা পালন করে থাকে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রধান থেকে শুরু করে বাড়িতে কাজ করতে আসা গৃহকর্মী পর্যন্ত সবাই নারী। তারপরও নারী নির্যাতনের যে ভয়াবহতা সমাজে প্রত্যক্ষণীয় তা সত্যিই হতাশাজনক।


বর্তমানে নারীকে পরিবারের সহিংসতার পাশাপাশি সমাজের ঘৃণ্য অপরাধের সাক্ষী হতে হচ্ছে। আবার অপরাধী সেও তো কোনো এক নারীরই সন্তান। যদিও পৃথিবীর কোনো মা চান না তার জন্ম দেওয়া সন্তান অপরাধ করুক। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, যখন কোনো নারীর সঙ্গে অপরাধ সংঘটিত হয় তখনো এই নারীকেই শুনতে হয় কটু কথা। সামাল দিতে হয় ভয়ংকর পরিস্থিতিগুলোকে যেখানে তার পাশে সে ছাড়া আর কেউ থাকে না। আর নারীর নিরাপত্তা, সে তো সবচেয়ে বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন এ সময়ে। তাই বোধহয় এবারের নারী দিবসের থিম দেওয়া হয়েছে`Choose to Challenge' শিরোনামে। যেখানে নারীকে ঘরে বাইরে সব জায়গায় নিরাপদ থাকার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।


কলকাতার নিউজ লাইফস্টাইলে এ বিষয়ে কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যা আমার নারী পাঠকদের জন্য তুলে ধরলাম। ঘরের মূল ফটককে নিরাপদ রাখার জন্য নিশ্চিত না হয়ে কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিতে যাবেন না। কর্মক্ষেত্রে বা বাড়ির বাইরে যাওয়ার আগে অবশ্যই কাউকে নিজের গন্তব্য জানিয়ে দিন। বাসায় ফিরতে দেরি হলে বা যানবাহনে একা উঠলে তার নম্বর মেসেজ করে রাখবেন। মোবাইলে লোকেশন অন রাখাতে পারলে আরো ভালো। এছাড়া মোবাইলে পর্যাপ্ত ব্যালেন্স ও মোবাইল যেন ফুলচার্জ থাকে তা মাথায় রাখতে হবে। পাশাপাশি জরুরি নম্বরগুলো মোবাইলে সেভ করে রাখার অভ্যাস করতে পারেন। চারপাশে পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা সজাগ রাখতে চেষ্টা করবেন, নাহলে বিপদে পড়লে মাথায় কিছু আসবে না। এজন্য উত্তেজিত বা ঘাবড়ে না গিয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে যতটুকু সম্ভব দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানসিকতা বাড়াতে হবে। মোবাইলে কোনো অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ধারণ করা বা পোস্ট করার বিষয়ে সচেতন হোন। এমনকি নিজের সন্তান বা পরিবারের সবার ছবি রেগুলার ফেসবুকে আপডেট করা থেকে বিরত থাকুন।


ওপরের বিষয়গুলো কোনো শাশ্বত চিরস্তন বাণী নয়, তারপরও সাবধানতা প্রতিরোধের মতো কাজ করে। তাই সজাগ ও সাবধান হলে অনেক বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। নারী এক অদম্য শক্তি যার অশ্রু হয়তো অনেক সহজে ঝরানো যায়, কিন্তু এই শক্তি অনেক কষ্ট আর বিপদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সামাল দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তাই পুরুষের পাশাপাশি নারীকে সম্মান দিলে কেউ ছোটো হবে না বরং উভয়ে মিলেই পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র।


শেষ করতে চাই, বেগম রোকেয়ার লিখে যাওয়া সেই চিন্তা দিয়ে, যেখানে তিনি নারী ও পুরুষকে সাইকেলের দুই চাকার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন যার সামনেরটা বড় আর পেছনেরটা ছোট হলে বা গাড়ির চাকার একপাশ ছোট আর একপাশ বড় হলে গাড়ি যেমন চলতে পারে না ঠিক তেমনি নারী পুরুষ সমান তালে না চললে সমাজও আগাবে না। আবার এটাও মনে রাখতে বলেছেন যে, সৃষ্টিকর্তা যদি নারী-পুরুষকে আলাদাভাবে দেখতেন তাহলে নারীকে মায়ের গর্ভে পুরুষের অর্ধেক সময় পাঁচ মাস রাখতেন। জয় হোক নারী দিবসের, জয় হোক নারী সম্মানের।

লেখক :  পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়