logo
আপডেট : ১০ মার্চ, ২০২২ ১১:৪৭
বান্দরবানে আড়াই মাসে ১৮ খুন
রিজবি রাহাত, বান্দরবান

বান্দরবানে আড়াই মাসে ১৮ খুন

প্রতীকী ছবি

পাহাড়ের জেলা বান্দরবানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আড়াই মাসে ১৮ খুনের ঘটনা ঘটেছে।

একের পর এক এসব হত্যাকাণ্ডে উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে পার্বত্য জনপদ। পরিস্থিতির এমন অবনতিতে স্থানীয়দের মাঝে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। কমে গেছে ভ্রমণ পিপাষু পর্যটকের সংখ্যা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের প্রায় প্রথম আড়াই মাসে (৯ মার্চ পর্যন্ত) আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর চাঁদাবাজির এলাকা বাড়াতে প্রায়ই দ্বন্দ্ব লেগে যায়। ঘটে সশস্ত্র সংঘাত। এতে প্রাণহানি ঘটে দুপক্ষের কারো না কারো।

এভাবেই গত আড়াই মাসে খুন হয় ১৮ জন। এ অবস্থায় পাহাড়ে পর্যাপ্ত সেনা ক্যাম্প স্থাপন ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান জোরদারের দাবি জানিয়েছে স্থানীয় এলাকাবাসী ও সচেতন মহল।

বান্দরবানে ১১ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির পর থেকে শান্তি সম্প্রীতি নিয়ে বসবাস করে আসছেন এ জেলার মানুষ। তবে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তর্কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারে বিভিন্ন উপদল সৃষ্টি হওয়ায় সম্প্রতি এই দ্বন্দ্ব বেড়ে গেছে কয়েকগুন। প্রায়ই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। এতে প্রাণ হারাচ্ছেন সশস্ত্র সংগঠনের সদস্যসহ পাহাড়ের অনেক সাধারণ মানুষ।

জানা যায়, চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি লামা রূপসীপাড়া ইউনিয়নের অংহ্লা পাড়ায় শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে সন্ত্রাসীর গুলিতে নিহত হন মংক্যচিং মার্মা (৩৬)। এর তিনদিন বাদে অর্থাৎ ৬ জানুয়ারি সদরের রাজবিলা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড থংজমা পাড়ায় নিজ বাড়িতে খুন হন সিংয়ানু মারমা (৩০)।

২ ফেব্রুয়ারি রুমার বথিপাড়ায় একটি সেনাটহল দলকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। পরে উভয়পক্ষের গুলিবিনিময়ে সেনাবাহিনীর সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার হাবিবুর রহমান নিহত হন। একই ঘটনায় তিন সন্ত্রাসীও মারা যায়। এ ঘটনায় আরেক সেনাসদস্য ফিরোজ পায়ে গুলিবিদ্ধ হন।

২৫ ফেব্রুয়ারি রুমার গ্যালেংগা ইউনিয়নের আবু পাড়ায় পাড়াপ্রধান লংরুই ম্রোসহ (৬৫) তার পরিবারের পাঁচজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ওই পাড়ার ২২ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।

২৬ ফেব্রুয়ারি রোয়াংছড়ির নতুন পাড়ায় মংসিং শৈ মারমা (৩৬) নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

৩ মার্চ রোয়াংছড়ির নোয়াপতং ইউনিয়নের নারী কারবারি পাড়া এলাকার একটি জুম ঘরে চুইরংমা মারমাকে (৪০) গলা কেটে হত্যা করা হয়।

৫ মার্চ রোয়াংছড়ি উপজেলার তারাছা ইউনিয়নের মারমা পাড়ায় উনু মং রয়েল (৩৮) নামে জনসংহতি সমিতির এক সদস্যকে হত্যা করে মরদেহ নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। সবশেষ ৬ মার্চ রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলার মধ্যবর্তী তারাছা ইউনিয়নের মংবাইতং পাড়া এলাকার নদীর দক্ষিণপাড় থেকে গুলিবিদ্ধ চার পাহাড়ি যুবকের লাশ উদ্ধার করে রুমা থানা পুলিশ ও সেনাবাহিনী।

একের পর এক হত্যাকাণ্ডে বান্দরবান পরিণত হয়েছে এখন আতঙ্কের নগরীতে। পাহাড়ে সহিংসতা বন্ধে ও শান্তিশৃঙ্খলা ফেরাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি বান্দরবান জেলা শাখার সভাপতি অং চ মং বলেন, ‘১৯৯৭ সালে বর্তমান সরকার শান্তিচুক্তি করার পর বান্দরবানে শান্তি ছিল। তবে হঠাৎ করেই পার্বত্য জেলা বান্দরবানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠেছে। শান্তি ও সম্প্রীতি জেলা খ্যাত বান্দরবানের সুনাম অক্ষুণ রাখতে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মজিবর রহমান বলেন, ‘এ মুহূর্তে পার্বত্য এলাকায় অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে জোরালো অভিযান করা প্রয়োজন। পার্বত্য এলাকার শান্তি ভঙ্গ করে যারা দামি দামি গাড়ি নিয়ে ঘুরছে, কোটি কোটি টাকার চাঁদা আদায় করছে ও মানুষ হত্যা করে বান্দরবানসহ তিন পার্বত্য জেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের গ্রেপ্তার করে বিচার করা দরকার।’

তিনি আরো বলেন, ‘বান্দরবানের বিভিন্ন অরক্ষিত সীমান্ত এলাকায় সেনাবাহিনী ও বিজিবির চৌকি বৃদ্ধি করা দরকার। সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশের সমন্বয়ে পার্বত্য এলাকায় অশান্তি সৃষ্টিকারী সন্ত্রাসীদের একে একে খুঁজে বের করে নির্মূল করা সময়ের দাবি।’

জেলার পুলিশ সুপার জেরিন আখতার বলেন, ‘কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে বান্দরবানে থাকতে দেওয়া হবে না। সন্ত্রাসীদের কয়েকটি দল পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের মতো নৃশংস ঘটনা ঘটাচ্ছে। তবে তাদের জীবন ক্ষণস্থায়ী।’

তিনি আরো বলেন, ‘সম্প্রতি বান্দরবানে বেশকিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে এবং পুলিশ সংবাদ পাওয়া মাত্রই বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করেছে। যারা পার্বত্য এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে তাদের ধরতে পুলিশের অভিযান আগামীতেও অব্যাহত থাকবে।’