logo
আপডেট : ১০ মার্চ, ২০২২ ১১:৫১
ঠার: বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা
যেভাবে বেদে সংস্কৃতিতে আগ্রহী ডিআইজি হাবিব
রুদ্র মিজান ও তৌহিদুজ্জামান জিহাদ

যেভাবে বেদে সংস্কৃতিতে আগ্রহী ডিআইজি হাবিব

ডিআইজি হাবিবুর রহমান। ছবি- ভোরের আকাশ

ঠার। বেদে সম্প্রদায়ের ভাষা। বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে থাকা এই ভাষার গবেষণাধর্মী একটি বই প্রকাশিত হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। লেখক ভাষাবিদ না হলেও এই দায়িত্বটুকু পালন করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। পেশাগতভাবে তিনি ভিন্ন এক জগতের হলেও লেখালেখি, গবেষণা মিশে আছে তার সমগ্র সত্তাজুড়ে। তিনি পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান। তার লেখা বইটির নাম ‘ঠার : বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে গবেষণাধর্মী এই গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। ইতোমধ্যে গবেষক ও গবেষণাধর্মী বইয়ের পাঠকদের আকর্ষণ করেছে বইটি।

এই বই, বইয়ের পেছনের গল্প নিয়ে ভোরের আকাশের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন ডিআইজি হাবিবুর রহমান।

 

 

শুরুর কথা- যেভাবে ‘ঠার’ ভাষা নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি হয়

হাবিবুর রহমান বলেন, ঢাকার পুলিশ সুপার ছিলাম তখন। নিজের আগ্রহ থেকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে বেদেদের নিয়ে কাজ শুরু করি। যেহেতু তারা পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়। তাই তারা যেন সভ্য সমাজের মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে, সে জন্য যা যা করণীয় আমি তা করেছি। আমি যখন বিভিন্ন সভায় যেতাম তখন চেষ্টা করেছি, সমাজের একটি জনগোষ্ঠী হিসেবে যেন তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকে। সেই থেকে বেদে সম্প্রদায়ের লোকেদের সঙ্গে আমার জানাশোনা হয়।

ওই সময়ে আমি লক্ষ্য করলাম, তারা যখন নিজেদের সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে তখন এক ধরনের ভাষায় কথা বলে এবং যখন আমাদের সঙ্গে কথা বলে তখন প্রচলিত বাংলা ভাষা ব্যবহার করে। কৌতূহলী হয়ে তাদের ভাষা সম্পর্কে জানতে চাই। আমি জানতে পারি তাদের একটি নিজস্ব ভাষা রয়েছে, যার নাম ঠার। এই ভাষার কোনো বর্ণমালা বা লিপি নেই। তারা মুখে মুখে এই ভাষা ব্যবহার করে।

ভাষাটির ওপর গবেষণা নিয়ে জানতে চাইলে ডিআইজি হাবিবুর রহমান বলেন, ২০১৩ সাল থেকে মূলত আমি ভাষাটি নিয়ে কাজ শুরু করেছি। ভাষাটি সংরক্ষণে আমি কিছু শব্দ সংগ্রহ করেছি। তাদের বাক্য প্রয়োগের ধরন সংগ্রহ করেছি। এ রকম আস্তে আস্তে সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, যেখানে বেদে আছে তাদের কাছ থেকে এই ভাষাটির মূল অংশগুলো সংগ্রহ করেছি।

এজন্য বেদে সম্প্রদায়ের যুবক আমজাদ আমাকে নানা তথ্য দিয়ে সাহায্য করেন। গোপালগঞ্জের সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের প্রভাষক আমানত মোল্লাও আমাকে বইটি লিখতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। এমনকি তিনি বেদে পল্লিতে অনেক দিন রাত্রীযাপন করেছেন এবং তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জেনে আমাকে জানিয়েছেন।

‘আমরা তাদের জীবন নিয়ে বিনোদন করি। কিন্তু জীবনের অবস্থা সম্পর্কে জানি না’

হাবিবুর রহমান বলেন, বেদেরা বাংলাদেশের একটি পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়। তাদের নিজস্ব কিছু সংস্কৃতি রয়েছে এবং একটি ভাষা রয়েছে। কিন্তু তারা মূলত যাযাবর সম্প্রদায়ের লোক। স্থলে তাদের কোনো বাড়িঘর নেই। নৌকায় চলাচল করেই তাদের জীবন চলে। বাংলাদেশের নাটক, সিনেমা, উপন্যাস, সাহিত্যে তাদের জীবনযাপন নিয়ে লেখা আছে। আমরা তাদের জীবন নিয়ে বিনোদন করি। কিন্তু তাদের জীবনের অবস্থা সম্পর্কে জানি না। ঠিক সেরকম একটা চিন্তা থেকে তাদের সঙ্গে মিশতে গিয়ে বইটি প্রকাশের অনুপ্ররণা পাই।

‘একটি ভাষা হারিয়ে যাবে, তা মেনে নিতে পারিনি’

হাবিবুর রহমান বলেন, যেহেতু আমি ভাষাবিদ নই, তাই প্রথমে আমি চেষ্টা করেছিলাম যে, এই দায়িত্ব যাদের ওপর বর্তায় তাদের জানানোর। তাই আমি ভাষা গবেষক এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে ব্যাপারটি অবগত করি। যেন এটি নিয়ে কিছু তৈরি করা হয় এবং ভাষাটাকে সংরক্ষণ করা হয়।

কিন্তু আমি তাদের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাইনি। যেহেতু বাংলাদেশ মাতৃভাষার দেশ। এ দেশের মানুষই ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছে। সেই দেশে আরো একটি ভাষা হারিয়ে যাবে, তা আমি মেনে নিতে পারিনি। তখন আমি ভাষাটি নিয়ে কিছু করার চিন্তা করি।

বইটি লেখার আগে বাংলাদেশের যারা ভাষাবিদ রয়েছেন তাদের সঙ্গে আমি আলাপ করেছি। আমি ভাষা সম্পর্কে যা জানতাম না তা তাদের কাছ থেকে শিখেছি। এরপর বিভিন্ন জায়গায় যারা একই ভাষার লোক রয়েছে, তাদের ঢাকায় আমন্ত্রণ করেছি এবং এই ঠার ভাষার সম্মেলন করে সেখানে বিভিন্ন শব্দ তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি। তাদের উপস্থিতি এবং এক্সপার্টদের সমন্বয়ে মিটিং করে তারপর সবাই ঐক্যমত পৌঁছেছি এবং বইটি প্রকাশের উপযোগী করেছি।

‘বেদেদের সংস্কৃতি নিয়ে লেখা হয়েছে, পূর্ণাঙ্গ ভাষাবিষয়ক বই নয়’

ঠার ভাষা নিয়ে এর আগে অনেকে কাজের চেষ্টা করেছে, তবে তা খুবই সীমিত বলে জানান হাবিবুর রহমান। ভোরের আকাশকে তিনি বলেন, আমাদের দেশে রঞ্জনা বিশ্বাস নামে একজন ভাষাবিদ আছেন, যিনি একই ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন। আমি তার বইটিতেও কিছু শব্দ খুঁজে পেয়েছি।

লেখক নাজমুন নাহার লাইলি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও লেখক সৌরভ বেদেদের নিয়ে বই লিখেছিলেন। তাদের বইয়ে আমি অনেক অজানা শব্দ খুঁজে পেয়েছি। ভারতের কিছু বইতেও বেদেদের ভাষা নিয়ে শব্দ পাওয়া গেছে। তবে এর বেশির ভাগেরই বেদেদের সংস্কৃতি নিয়ে লেখা হয়েছে। তা পূর্ণাঙ্গ ভাষাবিষয়ক বই নয়।

‘বেদেদের অনেকেই পুলিশসহ বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে চাকরি করছে’

হাবিবুর রহমান বলেন, বংশ পরম্পরায় বেদেরা বিনোদনের পেশায় যুক্ত। যেমন সাপখেলা, বানর খেলা, দাঁতের পোকা ফেলানো এবং ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজ দেওয়া। এর থেকে মুক্তি দিয়ে তাদের সভ্য সমাজে ফেরানোর জন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।

বেদে সম্প্রদায়ের অনেককে আমি পড়াশোনা করিয়েছি। তাদের সরকারি চাকরির জন্য উদ্বুদ্ধ করেছি। প্রধানমন্ত্রীর প্রকল্পের আওতায় এনে তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছি। তারা অনেকেই পুলিশসহ বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে চাকরি করছেন।

‘বেদেদের নিয়ে যা করেছি, তা তাদের প্রতি ভালোবাসা থেকে’

ঠার ভাষার মতো অন্যান্য ভাষা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে কিনা- জানতে চাইলে ডিআইজি হাবিবুর রহমান বলেন, যেহেতু আমি একজন পুলিশ অফিসার। আমার নির্দিষ্ট একটি পেশা রয়েছে। বেদেদের নিয়ে যা করেছি, তা ছিল তাদের প্রতি আমার ভালোবাসা থেকে।

এই ধরনের বিভিন্ন ভাষা নিয়ে জাতিসংঘ এবং ইউনেস্কো কাজ করে। আমাদের দেশে সরকারিভাবে বিভিন্ন প্রোগ্রাম রয়েছে। এর পাশাপাশি মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট কিংবা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভাষা ইনস্টিটিউটগুলো রয়েছে তারাও যদি এসব ভাষা নিয়ে কাজ করে তাহলে আমাদের ভাষাগুলো আরো সমৃদ্ধ হবে।

তিনি বলেন, একটি ভাষাকে বিলুপ্তের হাত থেকে বাঁচিয়ে আমি আমার কর্তব্য পালন করতে পেরেছি- এটাই জীবনের পরম সার্থকতা।

 

গত ১৭ জানুয়ারি নতুন আঙ্গিকে প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক ভোরের আকাশ।

ভোরের আকাশের এই নবযাত্রা প্রসঙ্গে ডিআইজি হাবিবুর রহমান বলেন, একঝাঁক মেধাবী তরুণ সংবাদকর্মীর পত্রিকা ভোরের আকাশ পাঠক হৃদয়ে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করতে পারবে বলে মনে করি। বিশেষ করে পাঠক শ্রেণির ইচ্ছা এবং চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে চরম প্রতিযোগিতার যুগ টিকে থেকে দৃঢ় অবস্থান জানান দিতে পারবে- এই প্রত্যাশা রাখছি।