logo
আপডেট : ১০ মার্চ, ২০২২ ১৩:৪৬
জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস আজ
দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবিলায় রোল মডেল বাংলাদেশ
নিখিল মানখিন

দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবিলায় রোল মডেল বাংলাদেশ

গত ৫০ বছরের পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যায়, ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সাতটি বড় বন্যা হয়েছে। ছবি- সংগৃহীত

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ব্যাপক প্রস্তুতি ও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দুর্যোগ সহনশীল দেশ গড়তে কার্যকর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। জীবনের প্রয়োজনে দুর্যোগ ও এর কারণগুলো সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে। ঝুঁকিহ্রাসে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে দুর্যোগের দ্বারা ক্ষয়ক্ষতি এবং এর সম্ভাব্য নেতিবাচক ফল বহুগুণে কমিয়ে আনা সম্ভব বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে দুর্যোগে জীবন ও সম্পদের ঝুঁকি হ্রাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বর্তমানে বিশ্বে ‘রোল মডেল’ হিসেবে স্বীকৃত বলে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর জানায়, দুর্যোগ বলতে এমন একটি অবস্থা বুঝায় যা মানুষকে মন্দ বা অকল্যাণকর পরিস্থিতির সম্মুখীন করে। দুর্যোগ বলতে এমন একটি বিপর্যয় বুঝায় যা কোনো নির্দিষ্ট এলাকার জনগণের বেশির ভাগ মানুষকে বিপদাপন্ন করে তোলে এবং ওই জনগোষ্ঠীর তা মোকাবিলা করার ক্ষমতা সাধ্যের বাইরে চলে যায়। এসব দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে মানুষকে অনেক মূল্য দিতে হয়।

দুর্যোগ কখনো হঠাৎ সংঘটিত হয়, আবার কখনোবা এক বা একাধিক ঘটনা ধীরে ধীরে দুর্যোগ সৃষ্টি করতে পারে। আবার কখনো একটি দুর্যোগ একাধিক দুর্যোগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেমন-ভূমিকম্প থেকে সুনামি হতে পারে। সুনামি থেকে জলোচ্ছ্বাস এবং জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলীয় এলাকায় প্রবল বন্যা ও লবণাক্ততা হতে পারে।

পৃথিবীব্যাপী যেসব দুর্যোগ সংঘটিত হয় তা প্রধানত দুই ধরনের- প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। প্রাকৃতিক কারণে যেসব দুর্যোগ সংঘটিত হয়, সেগুলোকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে। এ ধরনের দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে- ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, নদীভাঙন, তুষারপাত, লবণাক্ততা ইত্যাদি।

পৃথিবীর প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্য, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রভৃতি কারণে প্রায় প্রতি বছরই কোনো না কোনো দুর্যোগে আক্রান্ত হয়। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে জনজীবন। ক্ষয়ক্ষতি হয় সম্পদ ও জীবনের। বাংলাদেশে সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, কালবৈশাখী ঝড়, বন্যা, নদী ভাঙন, লবণাক্ততা, খরা, আর্সেনিক, ভূমিকম্প ও সুনামি ইত্যাদি।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা করণে বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানায়, গত ৫০ বছরের পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যায়, ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সাতটি বড় বন্যা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যা বড় হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকা একসঙ্গে সক্রিয় হওয়ায় বড় বন্যা হয়। ১৯৮৭ সালে দেশের ৪০ শতাংশের বেশি আর ১৯৮৮ সালে ৬০ শতাংশের বেশি এলাকা প্লাবিত হয়। ৮০ শতাংশের বেশি এলাকা প্লাবিত হয় ১৯৯৮ সালের বন্যায়। পাঁচ-ছয় বছর ধরে দেশে বন্যা বাড়ছে।

বিবিএসে দেখানো হয়েছে, দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক প্রাকৃতি দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন সপ্তম। তবে দুর্যোগের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম। ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। জার্মানভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা জার্মানওয়াচ থেকে সম্প্রতি এটি প্রকাশিত হয়েছে। ১৮০টি দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের তথ্য নিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছে।

বাংলাদেশের দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা ও প্রস্তুতি নিয়ে ২০২০ সালে একটি গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাণহানি কমানো, দুর্যোগ মোকাবিলার একটি কাঠামোবদ্ধ মডেল প্রস্তুত করা এবং তা অনেক দেশ কর্তৃক অনুসরণসহ বাংলাদেশ দুর্যোগ মোকাবিলায় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করলেও এ খাতে এখনো যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধনের সুযোগ আছে এবং এখনই আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। কারণ ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এখনো বছরে জাতীয় আয়ের বড় অংশ ক্ষতি হয়।

সম্প্রতি রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, পরিশ্রম আর দূরদর্শী পরিকল্পনা এবং নতুন নতুন কৌশলকে কাজে লাগিয়ে বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে আজ সারা বিশ্বের কাছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অনুকরণীয় মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মোহসীন বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৮ হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে সিপিপির যাত্রা শুরু করেছিলেন যারা আগাম সতর্কসংকেত প্রচার এবং সন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষের জানমাল রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রেখে আসছে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় সিপিপি স্বেচ্ছাসেবক সংখ্যা ৭৬ হাজার ২০ জনে উন্নীত হয়েছে। এই স্বেচ্ছাসেবকদের ৫০ শতাংশ নারী। পুরো দেশজুড়ে আধুনিক আবহাওয়ার রাডার এবং পূর্বাভাস ব্যবস্থা রয়েছে।

দুর্যোগ মোকাবিলায় ধারাবাহিক সাফল্যের কারণে এশিয়া দুর্যোগ প্রস্তুতি কেন্দ্রের (এডিপিসি) নেতৃত্ব রয়েছে বাংলাদেশ। গত বছরের মার্চে বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে দুই বছর মেয়াদে সভাপতি নির্বাচন করা হয়। দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সাইকো সোশ্যাল সহযোগিতা অন্তর্ভুক্তি। এডিপিসি সদস্য দেশগুলো হচ্ছেÑ বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, চীন, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ড। এছাড়াও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আঞ্চলিক পরামর্শক কমিটিতে রয়েছে আরো ১৬টি দেশ।